“অমর একুশ ও বাঙালির বিজয়”

হাসিনা মরিয়ম

এ বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর হাজার রকম মানুষের আছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। নিজ নিজ দেশের ভাষা হলো জাতির ঐতিহ্য ও কৃষ্টি চর্চার উপাদান। যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি তাদের ভাষার জন্য লড়াই করছে। তাই পৃথিবীতে প্রত্যেক জাতির আছে নিজস্ব ভাষা এবং ঐতিহ্য। মাতৃভাষাকে উৎপাটিত করার আশংকা দেখা দিলে মানুষের সমস্ত সত্তা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইতিহাস থেকে বার বার আমরা এ শিক্ষা পাই।

বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, একটি জাতিকে পদানত করতে হলে আক্রমণকারী আগ্রাসী শক্তি শুধু সামরিক বিজয়ের উপর নির্ভর করেনি। যারা করেছে তাদের বিজয় ছিল ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু কোন আগ্রাসী শক্তি যখন পরাজিত জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে তখন ঐ ভাগ্যহত জাতি আর কোনদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি।

ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় বাঙালি জাতি ও পিছিয়ে নেই। এই দেশের মাতৃভাষা সৈনিক আর বাংলা ভাষা প্রেমিকগণ ১৯৪৮ সাল থেকে আন্দোলন জেল-জুলুম সহ্য করে ‘৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি রক্ত দিয়ে বিরল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। প্রতি বছর জাতি ধর্ম দলমত নির্বিশেষে একুশে ফেব্রুয়ারির শুভলগ্নে বাঙালিদের একতা থেকেই জন্ম নিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবোধ। আর সেই পথ ধরে বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন বহু রক্ত ঝরার পর শুরু হয়েছিল ‘৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ।

বস্তুতপক্ষে ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয় বাংলা ভাষার দাবি। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহ যখন ঘোষণা দেন উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা তখন উপস্থিত জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এর পরই বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত গ্র্যাজুয়েটগণ এর প্রতিবাদ জানান। এরপর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হয়।১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। এবার প্রতিবাদ হলো প্রচন্ডরূপে, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠিত হলো। চারদিকে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। সমগ্র জাতি,সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হলো সফলভাবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছাত্ররা মিছিল মিটিং ও বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা বেরিয়ে এলো রাস্তায়।পুলিশ প্রথম পাইকারীহারে গ্রেফতার করলো। হরতাল, অবরোধ, মিছিল করে ছাত্ররা আন্দোলনকে আরো তীব্র করে তুললো।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি ডাকা হলো ধর্মঘট । তখন ছাত্রদের একটা মিছিল এগিয়ে আসলে পুলিশ মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলিতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও অনেক নাম না জানা শহীদ হন। অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে
পড়লে গোটা জাতি এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ স্বরূপ পরবর্তী দুইদিন হরতাল পালিত হয়।

১৯৫২ সালে যারা ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তারা কি ভাবতে পেরেছিল তাদের সেদিনের সংগ্রাম একদিন সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছবে? বস্তুত বাঙালি জাতি ‘৫২-র পর থেকে পিছন ফিরে তাকায়নি। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য যে ‘৫২ থেকে ‘৭১ পর্যন্ত সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাঙালি জাতি তাদের মাতৃভাষার জন্য দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ‘৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির গুলির পর ৪৮ বছরের মধ্যেই মাতৃভাষা বাংলার জন্য উৎসর্গকৃত একুশে ফেব্রুয়ারি এনে দিয়েছে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশের প্রায় ৬ হাজার মাতৃভাষার সাথে বাংলা ভাষার এক মহান মর্যাদা।১৯৯৯ সালে
জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়,

বাঙালি জাতি রক্ত দিতে জানে। তাদের সত্যিকার দাবি আদায়ের জন্য চরম আত্মত্যাগে তারা কুণ্ঠিত নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি তার সাক্ষ্য হয়ে চিরকাল বিশ্ববাসীর প্রশংসা লাভ করবে। একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণ শুধু বাংলাদেশে নয়,পৃথিবীর দেশে দেশে হবে। তাই আজ শ্রদ্ধা জানাই একুশে ফেব্রুয়ারির সেই ভাষা সৈনিক শহীদ বরকত, সালাম, জব্বার, রফিক ও অন্যান্যদের। যাদের রক্তের পথ ধরেই ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ও ২৪শের গনআন্দোলনে এক সাগর রক্ত ঝরেছিল। ১৯৫২ থেকে ‘৭১, ও ৭১ থেকে ২০২৪,পর্যন্ত রক্তঝরা কোনদিন বৃথা যাবে না। সারা পৃথিবীর প্রায় সাড়ে ৬,০০০ মাতৃভাষার সাথে বাংলা ভাষাও স্মরণীয় হয়ে থাকবে যুগ-যুগান্তর ধরে।

বাংলা ভাষার আন্দোলনে শহীদ বীরদের স্মৃতিকে চির জাগ্রত রাখার উদ্দেশ্যে নির্মিত শহীদ মিনার পরিণত হয়েছে বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার যোগ্য স্থান। একুশের চেতনার আলোকে প্রথমে আমাদের শপথ নিতে হবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights