আগুন ঝুঁকিতে ৫৮ মার্কেট

নিজস্ব প্রতিবেদক

দালানের ইটগুলো আধভাঙা। খসে পড়েছে পলেস্তারা। প্রায় প্রতিটি দোকানের পিলার-ছাদে ফাটলের কারণে স্পষ্ট দেখা যায় লোহার রড। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কারওয়ান বাজারের ১ ও ২ নম্বর ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করলেও এখানে চলছে জমজমাট ব্যবসা। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের যাতায়াত এই বাজারে। শুধু কারওয়ান বাজারের এই মার্কেটই নয়, রাজধানীতে ১৫টি মার্কেট ও কাঁচাবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় আটটি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সাতটি মার্কেট রয়েছে। ঢাকার ৫৮টি মার্কেট আগুন লাগার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। বছরজুড়েই রাজধানীসহ সারা দেশে মর্মান্তিক আগুনের ঘটনা ঘটলেও আগুন নেভাতে বরাবরই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। অধিকাংশ সময় পানি-স্বল্পতার কারণে আগুন নেভাতে সমস্যায় পড়ছেন ফায়ার ফাইটাররা। সরু রাস্তায় পানি বহনকারী গাড়ি প্রবেশ করতে বাধছে বিপত্তি। ভরাটের দৌরাত্ম্যে উধাও হয়ে গেছে রাজধানীর খাল, পুকুর, জলাশয়। নগরীর রাস্তা, কারখানা, হোটেল, অধিকাংশ শপিং মলে নেই ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা। এতে আগুনে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যোগ হয়েছে উৎসুক জনতার ভিড়।

রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট এবং নিউমার্কেটে আগুন লাগার ঘটনায় ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট নিয়ে টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের। এই মার্কেটগুলোর দেয়ালে বহু বছর ধরে লাল কালিতে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড ঝোলানো থাকলেও ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা, মামলা, কর্তৃপক্ষের অনীহায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ঢিমেতালে নির্মাণকাজ করা এবং ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকায় বাধা দিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু রাজধানীর দুই গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটে আগুনের ঘটনায় এসব ঝুঁকির তালিকায় থাকা মার্কেট নিয়ে চলছে আলোচনা।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, নিউ সুপার মার্কেটসহ রাজধানীতে নয়টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ১৪টি মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। গত দুই সপ্তাহে ৫৮টি ভবন হালনাগাদ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তালিকায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে গাউছিয়া মার্কেট, বরিশাল প্লাজা মার্কেট, রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, লালবাগের আলাউদ্দিন মার্কেট, চকবাজার উর্দ্দু রোডের শাকিল আনোয়ার টাওয়ার, একই রোডে শহিদুল্লাহ মার্কেট, সদরঘাটের শরীফ মার্কেট, মায়া কাটারা মার্কেট ও সিদ্দিকবাজারের রোজনীল ভিস্তা। এর আগে গত বছর সারা দেশে ভবনগুলোর অগ্নি-নিরাপত্তার বিভিন্ন বিষয় পরিদর্শন করে ৪৫০টি ভবনকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছিল সংস্থাটি। তালিকায় গাউছিয়া মার্কেট, নূর ম্যানশন, রাজধানী সুপার মার্কেট, কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেট, লিলি প্লাজা ও ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন আটটি মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) একাধিকবার এসব মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না হওয়ায় এখান থেকে সরছেন না ব্যবসায়ীরা। এসব মার্কেট থেকে ব্যবসায়ীদের সরাতে আরও তিনটি মার্কেট বানানো হয়েছে। কিন্তু দোকান ছোট হওয়া, ব্যবসার পরিবেশ না থাকা এবং দখলে থাকা মার্কেটের জায়গা থেকে না সরার মানসিকতায় কাজে আসেনি সে উদ্যোগ। অব্যবহৃত পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার এসব ভবন। বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটে আগুন লাগায় নড়েচড়ে বসেছে ডিএনসিসি। ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘ডিএনসিসির আওতাধীন আটটি মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এগুলো ভাঙার ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঈদের পর ঝুঁকিপূর্ণ এসব মার্কেট ভাঙা শুরু হবে। এসব মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ব্যাপারেও বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে।’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পাঁচটি অঞ্চলে ৪৬টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে সাতটি মার্কেট রয়েছে। ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে লিলিপ্লাজা মার্কেট ভবন, খিলগাঁও রেলওয়ে কাঁচাবাজার, আজিমপুর কবরস্থান মার্কেট, আজিমপুর এতিমখানা মার্কেট, দয়াগঞ্জ ট্রাকস্ট্যান্ড রোড সাইট মার্কেট ভবন, ঠাঁটারীবাজার মার্কেট ও নওয়াব ইউসুফ মার্কেট কমপ্লেক্স। ঢাকার নিউমার্কেটের আওতাধীন নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি এবং ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণে ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ডিএসসিসি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ‘অগ্নিকান্ডের মতো দুর্ঘটনার সমাধানে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় ভবনগুলো পরিদর্শন করে বিশেষজ্ঞ টিম নিয়ে জরুরি সমস্যাগুলো আগে সমাধান করতে হবে। এরপর স্থায়ী সমাধানে নজর দিতে হবে। মার্কেট পুনর্নির্মাণ, ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো এবং রাস্তা-লেন সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এসব কাজে যেহেতু বড় অঙ্কের অর্থ লাগবে, তাই সামগ্রিক পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে হবে। স্থানীয়ভাবেও ফায়ার হাইড্রেন্ট বসিয়ে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য জলাধারের ব্যবস্থা করতে হবে। রাজধানীতে পানির সংকট কমাতে জলাধার সংরক্ষণের পাশাপাশি বাসাবাড়ির রিজার্ভে পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।’ নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি পরিকল্পিত নগরীতে আগুন নেভানোর জন্য বিভিন্ন রাস্তার ধারে ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ বসানো থাকে, যা সরাসরি পানির পাম্পের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া এবং এতে পানির অতিরিক্ত প্রেশার দেওয়া থাকে। কোথাও আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে পৌঁছামাত্রই হাইড্রেন্টের বাল্ব খুলে পানি ছিটানোর জন্য পাইপ লাগাবেন আর সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গতিতে পানি বেরিয়ে আসবে, যা দিয়ে সহজে ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। নগরপরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের দেশে অধিকাংশ এলাকা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা। যেখানে অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়ে ওঠে সেখানে ফায়ার হাইড্রেন্টের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো রাখা হয় না বা মানা হয় না। কর্তৃপক্ষ চাইলে এ ব্যবস্থা করা জটিল কিছু না। নগরে যে মানুষগুলো থাকে, তাদের নিরাপত্তা দেওয়াটা জরুরি। ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ও ভবনের বিষয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এভাবে জানমালের ক্ষতি মেনে নেওয়া যায় না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights