আমদানিকৃত আদার ‘নিয়ন্ত্রক’ শ্যামবাজার

সাম্প্রতিক সময়ে আদা নিয়ে চলছে মাতামাতি। বাংলাদেশে আদার বাজার ছিল চীনের দখলে। নিকট অতীতে বেশিরভাগ আদাই চীন থেকে আমদানি করে চাহিদা মেটানো হতো। কিন্তু চলতি মৌসুমে চীনা বুকিং রেট অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়াতে দেশে সংকট তৈরি হয়েছে।

পাশাপাশি ডলার সংকটে স্বাভাবিকভাবে এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে সেই সংকট তীব্রতর হয়েছে। এই সংকটের সুযোগ নিয়েছে প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট। তারা প্রভাব খাটিয়ে আদা আমদানি করে এবং সংকটে বেশি দামে বাজারজাত করে বড় অংকের মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আমদানিকৃত আদার মূল নিয়ন্ত্রক ঢাকার শ্যামবাজার। তাদের পেছনে রয়েছেন চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার আমদানিকারক সিন্ডিকেট। আমদানিকারক সিন্ডিকেট থেকে কয়েক হাত ঘুরে পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার হয়ে ভোক্তার হাতে যেতে প্রতি কেজিতে ২০০ টাকা পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যাচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত চার মাসে প্রায় ছয় হাজার টন আদা আমদানি হয়েছে। তারমধ্যে চার হাজার টন আমদানি করেছে শীর্ষ ১০ আমদানিকারক। বেশিরভাগ আমদানি করেছে ঢাকার শ্যামবাজারের আমদানিকারকরা। শুল্কায়ন পরবর্তী শুল্ককরসহ প্রতি কেজি আদার দাম পড়ছে ১০৪ টাকা থেকে ১৪১ টাকা পর্যন্ত। আর এসব আদাই হাত ঘুরে খুচরা দোকানে বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩২০ টাকা কেজিতে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আদার মূল বাজার চীন। এবার চীনে বুকিং রেট বেড়ে যাওয়াতে দেশে আদার সংকট তৈরি হয়েছে। সংকট তৈরি হওয়ায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে আদার বাজার। আর এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন আমদানিকারক সিন্ডিকেট। মঙ্গলবারও (৩০ মে) খাতুনগঞ্জের বাজারে ২৪০-২৬০ টাকা কেজিতে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমারের আদা পাইকারি বিক্রি হয়েছে।

খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডলারের সংকট দেখিয়ে ব্যাংকগুলো এলসি (ঋণপত্র) দিচ্ছে না। এতে মূল ব্যবসায়ীরা এক কনটেইনার আদা আমদানি করতে পারছেন না। আবার যাদের প্রভাব আছে তারা ২০-৩০ কনটেইনারও আমদানি করছেন।

খাতুনগঞ্জের লামার বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, মূল ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছেন না। অনেক প্রভাবশালী আদার ব্যবসায়ে জড়িয়েছেন। তারা ব্যবসা করছেন। তাদের কাছ থেকে কিনে আড়তদাররা ব্যবসা করছেন।

মধ্যম চাক্তাই এলাকার ব্যবসায়ী আবুল বশর বলেন, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, নতুন চাক্তাইয়ে সবই আড়ত। যারা আমদানি করছেন তাদের কাছ থেকে একটি পক্ষ কিনে নিচ্ছেন। আমরা ওই পক্ষ থেকে কিনে আড়তে বিক্রি করছি। এতে হাত ঘুরে দাম বাড়ছে। প্রশাসনের উচিত আদা আমদানি হয়ে বন্দরে আসার সঙ্গে সঙ্গে নজরদারি বাড়ানো। বন্দর থেকে বেরিয়ে এসব আদা কোথায় যাচ্ছে? কোথায় গিয়ে কত টাকা দাম পড়ছে? এখন খাতুনগঞ্জ কিংবা চাক্তাইয়ে অভিযান চালিয়েতো সুফল মিলবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মতে, গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ মে পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ৫৩টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ৫৯ লাখ ১৯ হাজার ১০০ কেজি আদা আমদানি করেছে। চীন, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, নাইজেরিয়া থেকে এসব আদা জাহাজে করে বাংলাদেশে আসে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আদা এসেছে ভিয়েতনাম থেকে। তারমধ্যে শীর্ষ ১০ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আমদানি করেছে ৩৯ লাখ ৪৪ হাজার ৭২০ কেজি আদা।

মেসার্স ভাই ভাই বাণিজ্যালয় নামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি চীন ও ভিয়েতনাম থেকে গত ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ মে পর্যন্ত চার মাসে চার লাখ ১৯ হাজার কেজি আদা আমদানি করেছে। চীন থেকে আসা একটি চালান গত ৭ ফেব্রুয়ারি শুল্কায়ন করা হয়। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী ওই চালানে শুল্ক করসহ প্রতি কেজি আদার দাম পড়ে ১১২ টাকা ৯০ পয়সা।

একই সময়ে খাতুনগঞ্জের মেসার্স সালেহ আহমেদ অ্যান্ড ব্রাদার্স ভিয়েতনাম থেকে সাত চালানে ১২ কনটেইনারে দুই লাখ ৮১ হাজার ৩০০ কেজি আদা আমদানি করেছে। গত ২৩ মার্চ প্রতিষ্ঠানটি ৭৩ হাজার ৯৮০ কেজির একটি চালান শুল্কায়ন করে। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী ওই চালানে শুল্ক করসহ প্রতি কেজি আদার দাম পড়েছে ১০৩ টাকা ৬৮ পয়সা।

কথা হলে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী সালেহ আহমেদ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমরা এত আমদানি করি না। বর্তমানে দেশে এলসি করাও অনেক কষ্টসাধ্য। আমি যে ১২ কনটেইনার আমদানি করেছি, তা থেকে ১০ কনটেইনার ঈদের (ঈদুল ফিতর) আগেই বিক্রি করে ফেলেছি। এখন বন্দরে আমাদের দুই কনটেইনার আদা রয়েছে।

তিনি বলেন, আমি গত ১৫ দিন আগে একটি এলসি করেছি। চালানটি গত দুয়েকদিন আগে বন্দরে এসেছে বলে জানান তিনি। বন্দর শুল্ককরসহ বর্তমানে ১২০-১৩০ টাকা খরচ পড়ছে বলে দাবি তার।

এ ব্যবসায়ী বলেন, এখন এলসি করেও আদা আমদানি করা যাচ্ছে না। সাপ্লাইয়াররা ননব্যাংকিং চ্যানেলে আগে নগদ টাকা নিচ্ছেন। তারপর আদা শিপমেন্ট (জাহাজীকরণ) দিচ্ছেন। তবে আমার চালানগুলোতে ননব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো টাকা দিতে হয়নি। তাছাড়া অনেক সাপ্লাইয়ার ওজনেও কম দেন বলে দাবি করেন এ আমদানিকারক।

অনেক সময় ২০ কেজির বস্তায় এক দুই কেজি কম হয়ে যায়। বস্তায় পণ্য কম দেওয়ার কারণে অবশিষ্ট পণ্যের ওপর পুরো পণ্যের কস্টিং পড়ছে। আবার আদা বস্তায় ভর্তি করে যত সময় বাড়ে তত ওজন কমে। এতে আদার কস্টিং বেড়ে যায়। এখন কেজিতে ১৬০-১৭০ টাকা পর্যন্ত আদার কস্টিং (আমদানি ও পরিবহন খরচসহ ক্রয় মূল্য) পড়ছে বলে জানান তিনি।

ঢাকার শ্যামবাজারের তাইতি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং নামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি গত চার মাসে সর্বোচ্চ ৯ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ কেজি আদা আমদানি করে। প্রতিষ্ঠানটি চীন, ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে আদা আমদানি করেছে। গত ১৩ এপ্রিল ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা ২৫ হাজার ৬০ কেজির একটি চালান শুল্কায়ন করে প্রতিষ্ঠানটি। এনবিআর বলছে, ওই চালানে প্রতি কেজি আদার দাম পড়েছে ১২৭ টাকা ৩৫ পয়সা।

একইভাবে চট্টগ্রামবন্দর দিয়ে দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আদা আমদানি করেছে আরেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স তাজ গ্লোবাল ট্রেডিং। তারা এই সময়ে ২৯ কনটেইনারে ৭ লাখ ৩৯ হাজার ৭৪০ কেজি আদা আমদানি করেছে। সর্বশেষ গত ২৭ মে ভিয়েতনাম থেকে আসা ২৬ হাজার কেজির একটি চালানের শুল্কায়ন করে প্রতিষ্ঠানটি। এনবিআর জানিয়েছে, ওই চালানে শুল্ককরসহ প্রতিকেজি আদার দাম পড়েছে ১৪০ টাকা ৩৫ পয়সা।

তাছাড়া মেসার্স এন এস ইন্টারন্যাশনাল মিয়ানমার থেকে ১২ কনটেইনারে তিন লাখ ২৪ হাজার কেজি, মেসার্স জেনি এন্টারপ্রাইজ ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ছয় চালানে দুই লাখ ৩৮ হাজার ১৮০ কেজি, মেসার্স জিয়াউর রহমান নামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে ১০ কনটেইনারে দুই লাখ ৫৭ হাজার ৭৬০ কেজি, নিউ বড়বাজার শপিংমল মিয়ানমার থেকে ১৫ কন্টেইনারে চার লাখ পাঁচ হাজার কেজি, রোনেও ট্রেডিং করপোরেশন ভিয়েতনাম থেকে তিন চালানে এক লাখ ২৬ হাজার ৭৮০ কেজি, মা বাণিজ্যালয় লিমিটেড মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে ৯ কনটেইনারে দুই লাখ ৪৩ হাজার কেজি, আল শামস এন্টারপ্রাইজ ভিয়েতনাম থেকে চার কনটেইনারে এক লাখ ৮ হাজার ২০ কেজি আদা আমদানি করেছে।

চট্টগ্রামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জিয়াউর রহমানের স্বত্বাধিকারী জিয়াউর রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, চীনে আদার এখন বুকিং রেট অনেক বেশি। এখন ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া থেকে আদা আসছে। আমাদের আদা সারাদেশে যায়। আমাদের মূল ক্লায়েন্ট হচ্ছেন পাইকাররা। সারাদেশের পাইকাররা আমাদের আদা নিয়ে যায়। এখন বন্দরে তাদের কোনো আদা নেই। যেগুলো আমদানি করা হয়েছিল সেগুলো আগেই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights