ইসলামিক ফাউন্ডেশন ‘ঘুষ দিলে চাকরি থাকে, না দিলে থাকে না’

শুভ সরকার,নড়াইল থেকে
নড়াইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় জেলার ৪৮২টি কেন্দ্রের শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরণের হয়রানি করা হচ্ছে। উৎকোচ না দেওয়ার কারণে গত এক বছরে ৪৫জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যেসব কেন্দ্রের শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, সেইসব শুন্য পদের বিপরীতে অর্থের বিনিময়ে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি শুনানির জন্য ভুক্তভোগী শিক্ষক এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানকে আগামী ৭ মে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সরাসরি উপস্থিত হতে বলা হয়েছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষকদের লিখিত অভিযোগে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম নড়াইলে বেশ সুনামের সাথে চলে আসছে। ২০২৩ সালের ১ মার্চ বর্তমান উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম শুরু হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষকদের কাছ থেকে অন্যায় ভাবে বিভিন্ন অঙ্কের ঘুষ দাবির অভিযোগ উঠেছে। ঘুষ দিতে না পারায় ৪৫জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
এদিকে, শুন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ। প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫০ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান এবং সুপারভাইজার ফাইজার রহমানসহ অফিস সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। নিয়োগ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিস থেকে সম্প্রতি ০১৯১৪-৬৬৭৮২৬ এই মোবাইল ফোন নাম্বার থেকে দেড় লাখ টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। যার কলরেকর্ডিং ভুক্তভোগীর কাছে সংরক্ষিত আছে।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বাবরা মধ্যপাড়ার সোনিয়া পারভীন বলেন, প্রায় আট মাসে আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন অফিস থেকে আমার কাছে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। আমি নিয়মিত কেন্দ্র পরিচালনা করলেও ঘুষের ৩০ হাজার টাকা দিতে না পারায় আমাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। জানুয়ারি থেকে সম্মানির পাঁচ হাজার টাকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সোনিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের ‘ঘুষ দিলে চাকরি থাকে, না দিলে থাকে না’। অপর ভুক্তভেভাগী শহরের ভওয়াখালী এলাকার খাজিদা খানম বলেন, আমাকে অফিসে ডেকে নিয়ে সাদা কাগজে সই নিয়েছে। পরে জানতে পারি, আমার চাকরি নেই। ঘুষের টাকা দিতে না পারায় আমার চাকরি হারাতে হয়েছে।
লোহাগড়া উপজেলার মাকড়াইল খানপাড়া কেন্দ্রের শিক্ষক সানজিদা খানম বলেন, আমি অসহায় বিধবা। এই চাকরি আমার সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে আমি কোনো রকম সংসার চালাতাম। হঠাৎ একদিন সকাল সাড়ে ৭টায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে পরিদর্শনে গিয়ে কোনো ছাত্রছাত্রী না দেখে আমাকে বিনা নোটিশে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ আমার কেন্দ্রে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা সকাল সাড়ে ৯টায়। তাহলে সকাল সাড়ে ৭টায় দিয়ে কীভাবে ছাত্রছাত্রী দেখতে পাবে ? চাকরিচ্যুত করায় আমি মানবেতর জীবনযাপন করছি।
এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে শুধু শিক্ষকদের কাছ ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ নয় ! তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা রকম আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। ২০২৩ সালে ৪৮২ জন শিক্ষকের কাছ থেকে জাকাতের কথা বলে জোরপূর্বক জনপ্রতি এক হাজার টাকা করে মোট ৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। একই কথা বলে চলতি (২০২৪) বছরে নেয়া হয়েছে জনপ্রতি দুই হাজার টাকা করে। এক্ষেত্রে মোট টাকার পরিমাণ নয় লাখ ৬৪ হাজার টাকা। ভুক্তভোগী অনেকের অভিযোগ সমাজ থেকে আমরাই জাকাত পাওয়ার যোগ্য। অথচ আমাদের কাছ থেকে জাকাতের নামে বর্তমান উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানের সময়ে অবৈধ টাকা তোলা হয়েছে। বিগত উপ-পরিচালকদের সময়ে এমন ঘটনার নজির নেই।
অপরদিকে, ২০২৩ সালের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর ইমাম সম্মেলনে নড়াইল থেকে ৫০০ ইমাম ঢাকায় যোগদান করায় সম্মানী বাবদ প্রত্যেক ইমামকে এক হাজার ২০০ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও তাদের কোনো টাকাই দেয়া হয়নি।
বিভিন্ন এলাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে জনসচেতনতামূলক উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও শিক্ষকদের কোনো সম্মানী দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে নড়াইল সদরের কমলাপুর কেন্দ্রের শিক্ষক মাওলানা ক্বারি ইদ্রীস আলী বলেন, আমার উঠান বৈঠকে ৪০ জনের বেশি উপস্থিত ছিল। আমাকে সম্মানী বাবদ ১৫০০ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও আমি আজও কোনো টাকা পাইনি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সুপারভাইজার ফাইজার রহমানের কাছে টাকা চাইলে তিনি বলেন, আমি টাকা কাকে দেব না দেব, সেটা আমার বিষয়। এই টাকার ভাগ উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানকে দেয়া লাগে। অভিযোগ করে কোনো লাভ হবে না। ভুক্তভোগী শিক্ষক ক্বারি ইদ্রীস আলী ঘটনটি উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানকে জানালে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি দেখছি।
জানা গেছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানের বাড়ি বাগেরহাট জেলায়। বিয়ে করেছেন নড়াইলের মহাজন এলাকায়। নিজ জেলা বাগেরহাট ও শ^শুরবাড়ি (নড়াইলের মহাজন) এলাকায় অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অফিসের এক কর্মচারী বলেন, উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান স্যার আঙুল ফুঁলে কলাগাছ হয়েছেন। প্রায় আট বছরের চাকরি জীবনে কয়েকটি ট্রাক, মাটিকাটা ভেকুমেশিনসহ রয়েছে কোটি টাকার বিভিন্ন ব্যবসা। বাগেরহাট ও শ^শুরবাড়ি মহাজন এলাকায় রয়েছে ঘেরসহ কয়েক কোটি টাকার জমির মালিক বনে গেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে ফিল্ড সুপারভাইজার ফাইজার রহমান বলেন, চাকরির জন্য কারোর কাছে কোনো প্রকার টাকা দাবি করিনি। ঊঠান বৈঠকের টাকাও আত্মসাতের প্রশ্ন উঠে না। কারোর চাকরি খাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
এ ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা ঠিক নয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে আমার একার কোনো হাত নেই। অফিসিয়াল নিয়মানুযায়ী চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ইমাম সম্মেলনে ইমামদের সম্মানীর টাকা যাতায়াত ও খাওয়া খরচ বাবদ ব্যয় করা হয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে জাকাত বাবদ ২০২৩ সালে এক হাজার ও ২০২৪ সালে দুই হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এম এম আরাফাত হোসেন বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights