‘ওরা ১১ জন’ ও বিরোধী দল প্রসঙ্গ

মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে স্বাধীনতা লাভের পরপরই নির্মিত এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্রের নাম ‘ওরা ১১ জন’। এই চলচ্চিত্রের পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পী ও নির্মাণের সঙ্গে জড়িত কলা-কুশলীদের একটি বড় অংশই ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত প্রেক্ষাপট এবং পাকহানাদার বাহিনীর নৃশংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের এক বাস্তবচিত্র ফুটে উঠেছিল ওই সিনেমার পরতে পরতে। আরও ফুটে উঠেছিল ১১টি সেক্টরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিকূলতাকে জয় করে ও জীবনবাজি রেখে প্রাণপণ যুদ্ধ করার এক অবিশ্বাস্য কাহিনি। খুব বড় দল বা বাহিনী নয়, ১১ জন অকুতোভয় লড়াকু যোদ্ধা কেবল দেশের মায়ায় কীভাবে মৃত্যুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষিত বাহিনীর ওপর বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শেষে চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনে, তা দেখে প্রবল দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা পেয়েছিল সেদিনের কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজ। আজ তাদের অনেকেই মহান সংসদের আসন অলংকৃত করেছেন।

পরিচালক ও মূল অভিনেতাসহ ওরা ১১ জন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ মানুষ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তবে কিংবদন্তি হয়ে আছে তাদের অমর সৃষ্টি ওরা ১১ জন। ইদানীং ওরা ১১ জন কথাটি বারবার আলোচিত হচ্ছে সদ্য সমাপ্ত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে। জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ১১ জন সংসদ সদস্য। সংখ্যার বিচারে এটি জাতীয় পার্টির ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল হলেও নির্বাচনবিষয়ক পর্যালোচনায় অনেকের কাছে তারা অসাধ্য সাধন করে জয়ী হয়েছেন। কারণ আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির ২৬ জন সদস্যকে সংসদে পাওয়ার আশায় সংশ্লিষ্ট ২৬টি আসন থেকে নৌকা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তবে সেই ২৬ জন থেকে জয়লাভ করেছেন ১১ জন। সেই সূত্রে জয়ী ওরা ১১ জন অবশ্যই কৃতিত্বের দাবিদার। এবার আওয়ামী লীগ তার নেতা-কর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের অনুমতি দেওয়ার কারণে দেশের প্রায় সর্বত্র ট্রাক, ঈগল ও অন্যান্য প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচন করেছেন। তবে এ ১১টি আসনে হার মেনেছেন বাকি সব প্রার্থী। সার্বিকভাবে ৬২ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হলেও এ ১১টি আসনে জিতেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। তাই তাদের জয়কে খাটো করে দেখার উপায় নেই।

তবে সমস্যা বেধেছে অন্য জায়গায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, তাদের আজ ছোট করে দেখছেন আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি-উভয় দলেরই একদল নেতা-কর্মী। এ ১১টি আসনে হেরে যাওয়া অন্য দলসহ স্বয়ং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে প্রশাসনের যোগসাজশের কথা বলে চলেছেন। জাতীয় পার্টির হেরে যাওয়া প্রার্থীরা রীতিমতো প্রতিবাদ করেছেন এ ১১ জনের বিরুদ্ধে এবং একটি অংশ তাদের পদত্যাগও দাবি করেছেন। বিজয়ী জাতীয় পার্টির নেতারাও বলেছেন, নির্বাচন ভালো হয়নি, সরকার যেখানে যার জয় দেখতে চেয়েছে, সেখানে তারই জয় হয়েছে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ‘ওরা ১১ জন’ নির্বাচিত জাতীয় পার্টি সংসদ সদস্য আবার মহান সংসদে বিরোধী দল গড়তে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অথচ তাদের নির্বাচনি প্রচারপত্রে লেখা ছিল ‘জাতীয় পার্টি মনোনীত ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত’ কথাটি। এখন তারা কোনমুখে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করবেন, সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে। আরও প্রশ্ন এসেছে ১১ জন সংসদ সদস্যবিশিষ্ট দলটির নেতার নামই কি উঠে আসবে দেশের বিরোধীদলীয় নেতার কাতারে, যে কাতারে এক দিন ছিলেন আসাদুজ্জামান, আ স ম আবদুর রব, শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া, বেগম রওশন এরশাদ ও এরশাদের মতো নেতারা?
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ২৯৩টি আসন। অবশিষ্ট আসনের মধ্যে একটি করে আসন পায় জাসদ (সাত্তার, টাঙ্গাইল-১) এবং বাংলাদেশ জাতীয় লীগ (আতাউর, ঢাকা-১৯)। অবশিষ্ট পাঁচটি আসন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা লাভ করেন।

পরের অর্থাৎ দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। এর ফলে বস্তুত স্বাধীনতার প্রথম আট বছর (ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯) বাংলাদেশের মহান সংসদে কোনো বিরোধী দল বা বিরোধী নেতা ছিল না। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে আওয়ামী লীগ (মালেক) এবং দেশের প্রথম সংসদীয় বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আসাদুজ্জামান খান ৩৯ জন সংসদ সদস্য নিয়ে মহান সংসদে প্রবেশ করেন। এ সময় ক্ষমতাসীন বিএনপি আসন পায় ২০৭টি। এরপর ১৯৮৬ সালে এরশাদ আমলে শেখ হাসিনা ৭৬ সংসদ সদস্যবিশিষ্ট বিরোধীদলীয় নেতা হন। ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ২৫১টি আসনের বিপরীতে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) পায় ১৯টি আসন। এই জোটের নেতা আ স ম আবদুর রব (মূলত জাসদ একাংশের নেতা) হন বিরোধী দলের নেতা। এ সময় থেকেই গৃহপালিত বিরোধী দল কথাটি ব্যাপক প্রচার পায়।

এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কাছে হেরে আওয়ামী লীগ হয় বিরোধী দল। আর বিরোধীদলীয় নেত্রী হন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটলে একই বছর দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ নির্বাচনে বিএনপির বাইরে উল্লেখযোগ্য কেউ অংশ না নেওয়ায় ফ্রিডম পার্টি একটি আসন পায় ও স্বতন্ত্ররা পায় ১০টি আসন। আর ১২ জুনের নির্বাচনে এই বিএনপির ভাগ্যে জুটে ১২৬টি আসন আর আওয়ামী লীগ পায় ১৪৪টি আসন। ফলে বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেন বেগম খালেদা জিয়া।

২০০১ সালে শেখ হাসিনা সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধীদলীয় নেত্রী হন। কারণ তাঁর দল পায় মাত্র ৬২টি আসন। আর ১৯৩ আসন পেয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি। ২০০৭ সালে ক্ষমতা হারিয়ে বিএনপি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তাই ২০০৮ সালে ৩০ সংসদ সদস্যবিশিষ্ট বিরোধী দলের নেত্রী হন বিএনপির বেগম খালেদা জিয়া। এরপর ২০১৪ সালে বেগম রওশন এরশাদ এবং ২০১৮ সালে এরশাদ ও তাঁর মৃত্যুর পর আবার রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় এবার হয়তো আসছেন একজন জি এম কাদের। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, কাগজে-কলমে বিরোধী দল বা বিরোধী নেতা হয়েও সংসদে কমই উপস্থিত ছিলেন এসব নেতা। সমালোচনা করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার মতো কোনো পরিস্থিতি অতীতে এসব বিরোধী দল বা বিরোধী দলের নেতারা কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি। তবে বিরোধীদলীয় নেতার জন্য বরাদ্দ সব সুবিধা নিয়েছেন এসব নেতা। এই কাতারে এবার শামিল হতে চান, ওরা ১১ জনের নেতা জি এম কাদের। অতীতের বিরোধী দল থেকে মন্ত্রী হয়েছেন এ ১১ জনের তিনজন। বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে বেগম রওশন এরশাদ সরকারের কাছে মন্ত্রীদের ফেরত চেয়েও পাননি। তারপরও ৬২ জন স্বতন্ত্রের সম্ভাব্য জোটকে টেক্কা দিয়ে বিরোধী দলের পরিচিতি পেতে ১১ জনের আগ্রহ বেশ সাড়া ফেলেছে। বিরোধী দল কী এবং কেন প্রয়োজন, তা নিয়ে আমাদের সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞানের অভাগা শিক্ষার্থীদের অনেক পড়ালেখা করতে হয়েছে। মনে পড়ে রাত জেগে পড়েছি, বিরোধী দল মানে ‘ছায়া সরকার’, যারা সঠিক পথে না চললে অনাস্থা ভোটে সরকারের পতন ঘটাবে ও তাৎক্ষণিকভাবে নতুন সরকার গঠন করবে। সেই অর্থে বিরোধী দলকে সরকারের জন্য ছদ্মাবরণে মঙ্গল বা ব্লেসিইং ইন ডিসগাইস বলা হতো। সরকারের যত মন্ত্রণালয় বা বিভাগ থাকে, বিরোধী দলেও তেমনি বিষয়ভিত্তিক সম্পাদক থাকার কথা, যারা নিজ নিজ বিষয়ে সরকারের নীতিগুলোর ভালোমন্দের ওপর জাতিকে অবহিত করবেন। যেমন দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে সরকারের নানা পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলার জন্য বিরোধী শিবিরেও একজন অর্থনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ বা ‘শেডো অর্থমন্ত্রী’ থাকার কথা। এসবই যেন আজ কাজির গরু, কেতাবে আছে, বাস্তবে নেই।

বিশ্বজুড়ে আজ বিরোধীদের ধ্বংসের অদ্ভুত ও অনভিপ্রেত তৎপরতা দৃশ্যমান। চীন একটি গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ। বাস্তবে তা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) দ্বারা শাসিত একটি একদলীয় রাষ্ট্র। সেখানে সিসিপির অধীনস্থ ৮টি ছোট রাজনৈতিক দল বিদ্যমান। শাসনতন্ত্র মতে চীনে সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য হলো, দেশটিতে সব সময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) নেতৃত্ব থাকতে হবে। অন্য একটি ধারায় সংবিধান সিসিপিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সর্বোচ্চ শক্তি বা হায়েস্ট ফোর্স ফর পলিটিক্যাল লিডারশিপ বলে ঘোষণা দিয়েছে। বর্তমানে চীনের সংসদে ২৯৮০টি আসনের মধ্যে সিসিপির নিয়ন্ত্রণাধীন ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের আসন ২০৯১টি। এর বাইরে ৮টি ছোট ছোট দল আছে এবং সিসিপিই তাদের সংসদে এনেছে। রাশিয়া, ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বব্যাপী বিরোধীদের আজ নাজুক অবস্থা।

আজ থেকে ৫০ বছর আগে (১৪ ডিসেম্বর ১৯৭৪) পৃথিবী ছেড়েছেন আমেরিকার লেখক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াল্টার লিপম্যান। ৬০ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে কোল্ড ওয়ার, স্টেরিও টাইপ, মিডিয়া অ্যান্ড ডেমোক্রেসি- এমন বহু রাজনৈতিক প্রবাদের সঙ্গে বিশ্ববাসীকে তিনি পরিচয় করিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক কলাম ও ‘পাবলিক ওপেনিয়ন’ নামক বইয়ের মাধ্যমে। শেষ করব তাঁর একটি বাণী স্মরণ করে। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে কেবল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য নয়, বাঁচিয়ে রাখতে হবে তা অপরিহার্য বিধায়।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email: directoradmin2007@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights