টাকা যায় প্রাণও যায়
জয়শ্রী ভাদুড়ী
প্রতি বছর ডেঙ্গুজ্বরের মৌসুম এলেই তোড়জোড় শুরু হয় মশানিধন নিয়ে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের ১১ সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়নে শুধু মশা মারার পেছনেই বরাদ্দ করা হয় ৩৬০ কোটি ২৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। অথচ ২০২৩ সালে মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০৫ এবং গত বছর মারা গেছেন ৫৭০ জন। বিপুল অঙ্কের অর্থ ঢাললেও মশা নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
স্থানীয় সরকার এবং সিটি করপোরেশনগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশানিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ছিল ১২২ কোটি টাকা। মশানিধন কার্যক্রম পরিচালনা, যন্ত্রপাতি কেনা, ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচার কাজে এই অর্থ ব্যয় করা হয়। একই খাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাজেট ছিল ৪৭ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। মশানিধনে গাজীপুর সিটি ৪ কোটি ৭০ লাখ, নারায়ণগঞ্জ সিটি ২ কোটি, রাজশাহী সিটি ৭৩ লাখ ২৮ হাজার, রংপুর সিটি ৭৫ লাখ, বরিশাল সিটি ৬ কোটি এবং খুলনা সিটি করপোরেশনের বাজেট ছিল ১০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করেছে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) থেকে বরাদ্দ পেয়েছে ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু সিলেট সিটি করপোরেশনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোনো বরাদ্দ ছিল না বলে জানান প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম। ৪২ ওয়ার্ড নিয়ে গড়ে ওঠা সিলেট সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় মশা নিধনের জন্য ২৫০ জনের মতো জনবল দরকার থাকলেও আছে মাত্র দুজন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বছরব্যাপী সিটি করপোরেশন মশক নিধন কর্মসূচি পরিচালনা করে। প্রতিদিন প্রতিটি ওয়ার্ডে লার্ভিসাইডিং এবং ফগিং করা হয়। এখন কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে এবং এডিস নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সারা দেশ থেকে জটিল ডেঙ্গু রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। কিন্তু এই রোগীদের ঠিকানা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন লেখা হয়। একইভাবে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে ওই এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। তাই মশকনিধনে নির্দিষ্ট এলাকা নয়, সবাইকেই সমন্বয় করে একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।’
স্থানীয় সরকার বিভাগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগ দেশের ১২ সিটি করপোরেশনকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচারের জন্য আরও ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। দেশের সব পৌরসভায় ডেঙ্গু মোকাবিলা ও পরিচ্ছন্নতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সারা দেশের ইউনিয়নের অনগ্রসরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ডেঙ্গু মোকাবিলায় ১০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মশকনিধনে এই অর্থবছরে ৩৬০ কোটি ২৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছর ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন মানুষ ডেঙ্গু রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালে আক্রান্ত ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ এবং মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। যদিও এই পরিসংখ্যানটি সম্পূর্ণ নয়। কারণ এটি শুধু যেসব হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে রিপোর্টিং করে তাদের তথ্য। এ ছাড়া অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে, যার তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে পৌঁছায় না। আবার অনেক রোগী বাসায় থেকেও চিকিৎসা নিয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০০০ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই কমবেশি ডেঙ্গু হয়েছে। ডেঙ্গু এবং বাহক মশা সম্পর্কে সবাই অবগত এবং নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাও জানা। তার পরও আমরা কেন ব্যর্থ হচ্ছি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে? আমাদের বর্তমান ফোরকাস্টিং মডেল বলছে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ ঘটাতে না পারলে চলতি বছরও বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। শুধু ঢাকায় নয়, বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় ডেঙ্গু আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মশার কামড়ে প্রতি বছর মানুষ মারা যাচ্ছে। তাই মশক নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। মশকনিধনে অর্থ খরচ হলেও কাজ হচ্ছে না। আমরা এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করব।’