দিনভর শুধুই ভাঙার শব্দ
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। গতকাল সকালেও ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ওই বাড়ি ঘিরে শত শত উৎসুক মানুষের ভিড় দেখা গেছে। নারী, শিশুসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ওই বাড়ির পুরো এলাকা ঘুরে দেখে। পেছনের দিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে ছয় তলা ভবনটিও ভাঙতে দেখা গেছে। ভিতরে পুড়ে যাওয়া তিনটি গাড়ির লোহাও কেউ কেউ নিয়ে যাচ্ছেন। তিন তলা প্রধান ভবনটির অর্ধেক গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুব দিকের ছোট তিন তলা ভবনটিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে দিনভর প্রতিটি ভবনের ভিতর থেকে হাতুড়ির আঘাতে নানা কিছু ভাঙার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
ভবনগুলোর প্রতিটি কক্ষে আগুন ও ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা যায়। কোথাও কোথাও টাইলসও খুলে ফেলা হয়েছে। পোড়া গন্ধ চারদিকে। বিকালে সেখানে উৎসবের অংশ হিসেবে একটি গরু জবাই দেওয়া হয়।
এর আগে ভারতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির ছয় মাস পূর্তির দিন বুধবার রাতে বুলডোজার মিছিল কর্মসূচি থেকে এ ভাঙচুর শুরু হয়। রাতেই একটি ক্রেন ও দুটি এক্সকেভেটর দিয়ে ওই বাড়ি ভাঙা শুরু হলেও গতকাল সকালে দেখা যায় একটি এক্সকেভেটর। যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলে সকাল সাড়ে ১০টায় সেটিও সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বাড়ি ভাঙার মধ্যেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উৎসুক জনতার ভিড়ে আওয়ামী লীগের সদস্য সন্দেহে এক নারীসহ দুজনকে পিটুনি দেয় ছাত্র-জনতা। প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা বলছেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় এক নারীকে এবং কথা বলার সময় ‘আপার বাড়ি’ বলায় এক পুরুষের ওপর হামলা চালিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের মারতে মারতে ধানমন্ডি ৩২ থেকে প্রধান সড়কে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে এক ফটোসাংবাদিকসহ কিছু লোক তাদের রিকশায় উঠিয়ে দেন। এ সময় ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য দেখা যায়নি। তাৎক্ষণিকভাবে ওই নারীর বাসা ফার্মগেটে জানা গেলেও তাঁর নাম-পরিচয় জানা যায়নি। বাড়ি ভাঙার দৃশ্য দেখতে আসেন শেখ মুজিবুর রহমানকে খুনের অভিযোগে মৃত্যুদে দি ত মেজর (অব.) বজলুল হুদার ছোট ভাই নুরুল হুদা ডিউক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিপ্লবী জনতা প্রমাণ করে দিয়েছে এ দেশে স্বৈরাচারের কোনো স্তম্ভ থাকবে না। এ স্বৈরাচারের চিহ্ন থাকলে তারা আবার ফিরে আসবে। তারা হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে। তাদের কোনো স্মৃতি এ দেশে রাখা যাবে না। আমার ভাই জাতীয় বীর ও মুক্তিযোদ্ধা মেজর বজলুল হুদা বাকশাল হটিয়েছিল। আমার ভাইকে খুনি হাসিনা জেলখানায় হত্যা করেছিল। তারা আমার পরিবারের অনেককে হত্যা করেছে। সেই হত্যার বিচার চাই।’
এদিকে দুপুর গড়ালেও জাদুঘরের বর্ধিত ছয় তলা ভবনটিতে শত শত মানুষ যাওয়া-আসা করে। সামনের আধাভাঙা দুটি ভবনেও উৎসুক মানুষের ঢল ছিল। কেউ কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন, কেউ ড্রোন উড়িয়ে চিত্র ধারণ করছেন। আবার কিছু সময় পরপর কাউকে কাউকে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
বাড়ির সামনে একটি মাইকে ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা’; ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’; ‘৩২ না ৩৬, ৩৬ ৩৬’; ‘একটা একটা লীগ ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’; ‘দালালি না আজাদি, আজাদি আজাদি’ ‘খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই’; ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’; ‘জনে জনে খবর দে, মুজিববাদের কবর দে’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়।
সেখানে আসা রফিক আহমেদ নামে একজন বলেন, ‘যে মানুষটি দেশে চরম ক্ষমতা দেখিয়েছে, দম্ভ-অহংকার দেখিয়েছে আজ সেই মানুষটির বাড়ি সাধারণ মানুষ ভেঙে দিচ্ছে, যে-যার মতো ইটগুলো খুলেও নিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরাচারের এমন পরিণতি দেখে ভবিষ্যতে যে ক্ষমতায় আসবে সে শিক্ষা নেবে। ইতিহাস থেকে যে শিক্ষা নেবে না তার পরিণতি এমনই হবে।’
জুলাই গণ অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সেদিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছিল বিক্ষুব্ধ জনতা। এর পর থেকে বাড়িটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।