পাচার বাড়ছে ব্যাংকে টাকা জমার বিধিনিষেধে

নিজস্ব প্রতিবেদক

যে কোনো ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ টাকা বা তার বেশি পরিমাণের অর্থ জমা দিতে গেলে অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে চায় ব্যাংকগুলো। টাকা জমার ক্ষেত্রে এরকম বিধি-নিষেধের কারণে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে দুবাই সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এতে অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ কমে গেছে। আর্থিক সংকট কাটাতে এখন থেকে কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়াই যে কোনো অংকের টাকা ব্যাংকে জমার সুযোগ দেওয়ার পরামর্শ বিশ্লেষকদের।

বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১ লাখ টাকা বা তার বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা দিতে গিয়ে তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন। ব্যাংকারদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে তারা ব্যাংকে টাকা রাখায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় বাড়তি প্রশ্ন না করার নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনা মানছে না ব্যাংকগুলো। ফলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১ লাখ টাকা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশ্ন করার মানে এখানে ব্যাংকারের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়াই যে কোনো পরিমাণের অর্থ ব্যাংকে জমা দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আমার জানা মতে ১ লাখ টাকা নয়, ১০ টাকা লাখ টাকা জমায়ও গ্রাহকের কাছে অর্থের উৎস জানতে চাইতে পারে না ব্যাংক।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ব্যাংকাররা চোর ধরতে আসে নাই। ব্যাংকারের দায়িত্ব পুলিশের ভূমিকা পালন করা নয়। গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রেখে টাকা জমা নেবে ও ঋণ বিতরণ করবে। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রাহককে হয়রানি করা যাবে না। ব্যাংকে নগদ অর্থের প্রবাহ বাড়ানোর জন্য টাকা জমার নিয়মকানুন সহজ করতে হবে। এতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগরিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে দুবাই ও সিঙ্গাপুরে। অর্থ পাচারের আরেক গন্তব্য সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে। সুইস ব্যাংকে ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ৫ কোটি ৫৩ লাখ সুইস ফ্রাঁতে দাঁড়িয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশিদের জমা থাকা ৫ কোটি ৫৩ লাখ সুইস ফ্রাঁর মধ্যে ৩ কোটি ৫৬ লাখ ব্যক্তি পর্যায়ের। টাকা জমা দিতে গিয়ে হয়রানির শিকার ও ব্যাংকারদের নানা রকম প্রশ্নের কারণে মানুষ এখন আর ব্যাংকমুখী হচ্ছেন না। নগদ টাকা কাছেই রেখে দিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি। গত বছরের ডিসেম্বরে মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সুদহারের ৯-৬ সীমা তুলে নেওয়ার পরও মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখছে না। আমানতে ৯ শতাংশের বেশি সুদ দিয়েও মানুষ ব্যাংকমুখী হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরও মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখছে না। জমা দেওয়ার সময় গ্রাহককে হয়রানি করা যাবে না। এতে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে চায় না। ব্যাংক সেবা আরও সহজ করতে হবে। আস্থা ফেরাতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে। ব্যাংকের সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে। সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গেলে আমানতকারীদের ব্যাংকাররা বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। বিশেষ করে টাকার উৎস জানতে চান। এতে গ্রাহকরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন। তাই গ্রাহকদের কাছে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত অর্থের উৎস জানতে চেয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন না করার এবং গ্রাহকদের হয়রানি না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights