প্রীতি উড়াংদের মরতে হয় কেন

১৫ বছর বয়সি প্রীতি উড়াংয়ের মৃত্যু কেন হলো? প্রীতি উড়াংদের মরতে হয় কেন? প্রীতির বয়স ১৫। প্রীতির তো বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। তা না গিয়ে লোকের বাড়ির দাসি হতে গিয়েছিল কেন সে? কারণ, দারিদ্র্য। তার বাবা চা বাগানের শ্রমিক লুকেশ উড়াং দারিদ্র্যের জ্বালা সইতে না পেরে কন্যাকে দাসির কাজ করতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু লুকেশ উড়াং কোনও পাষন্ড বর্বর শিশু নির্যাতক বা শিশু ধর্ষকের বাড়িতে প্রীতিকে পাঠায়নি। পাঠিয়েছিল এক সভ্য শিক্ষিত ভদ্রলোকের বাড়িতে, যে বাড়িতে ভদ্রলোকরা এবং ভদ্রমহিলারা দাসিদের দাসি বলে ডাকেন না, ডাকেন গৃহকর্মী বা গৃহপরিচারিকা বা গৃহসহায়িকা বলে। দেশের প্রখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক আশফাকুল হকের বাড়িতে গৃহকর্মীর চাকরি দেওয়া হয়েছিল কিশোরী প্রীতিকে। নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব যিনি পালন করছেন, যে কেউ অনুমান করবে তিনি সমাজ সচেতন ব্যক্তি, তিনি বিবেকবান মানুষ, কারণ তিনি মানবাধিকার সম্পর্কে জানেন, তিনি মানুষকে মানবতার শিক্ষা দিচ্ছেন প্রতিদিন, ধনী দরিদ্রের বৈষম্য ঘোচানোর উপদেশ দিচ্ছেন, দরিদ্রকে দরিদ্র বলে অসম্মান না করার শিক্ষা প্রতিদিন দিচ্ছেন, নারী পুরুষের বিভেদ মানছেন না, ধর্ষণ আর যৌন হেনস্তার প্রতিবাদ করছেন, শ্রেণিভেদ ঘুচিয়ে দেওয়ার কথা লিখছেন পত্রিকায়! কিন্তু প্রশ্ন জাগে, তাঁর বাড়িতে তিনি শিশুদের গৃহকর্মী হিসেবে রাখেন কেন? তিনি কি শিশুশ্রমের পক্ষে? তিনি নিশ্চয়ই শিশুশ্রমের পক্ষে। মানুষ তবে কাদের কাছ থেকে শিখবে প্রতিটি শিশুরই বিদ্যালয়ে যাওয়ার, বিদ্যা অর্জন করার, অন্ন বস্ত্র বাসস্থান পাওয়ার অধিকার যে জন্মগত, সে কথা? কাদের কাছ থেকে শিখবে প্রতিটি শিশুরই শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতিত না হওয়ার অধিকার যে জন্মগত, সে কথা? মানুষ তবে কাদের কাছ থেকে শিখবে কারও যে অধিকার নেই কোনও শিশুর অধিকার লঙ্ঘন না করার, সে কথা? বয়স্ক লোকদের নোংরা ফেলার দায়িত্ব যে শিশুদের নয়, বয়স্কদের ভার বহন করার দায়িত্ব যে শিশুদের নয়-এ তো দেশের দায়িত্ববান নাগরিকরাই জনগণকে শেখাবেন। কিন্তু কী শিখিয়েছেন আশফাকুল হক? তাঁর ন’তলা ফ্ল্যাট থেকে ৬ মাস আগে ৬ আগস্ট তারিখে ফেরদৌসি নামের এক শিশু, যাকে দিয়ে তিনি দাসির কাজ করাতেন, লাফ দিয়েছিল নিচে। গুরুতর আহতও হয়েছিল। কিন্তু কেন শিশুটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালাতে চেয়েছিল? কী ঘটেছিল ফ্ল্যাটে? ফেরদৌসির মতো প্রীতি উড়াংকে একইভাবে নিচে পড়তে হলো, রক্তে ভাসতে হলো, অবশেষে মরতে হলো। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে প্রীতির শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। বলেছে প্রীতিকে নির্যাতন করা হয়েছে, খুন করা হয়েছে এবং তারপর ন’তলা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কেউ বলছে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ফেরদৌসির মতো প্রীতিও পালাতে চেয়েছিল।

নির্বাহী সম্পাদক আশফাকুল হককে মোট ৬ জনসহ এবার গ্রেফতার করা হয়েছে। আগেও কিন্তু তাঁকে গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পাহাড়ি ছাত্রদের একটি সংগঠন প্রীতি হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেছে এবং অভিযোগ করেছে, লুকেশ উড়াংকে দু’লাখ টাকা দিয়ে মামলা থেকে উদ্ধার পেতে চেয়েছেন আশফাকুল হক।

ধরা যাক ফেরদৌসি এবং প্রীতিকে কেউই জানালা দিয়ে ফেলে দেয়নি। তারাই লাফ দিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ৬ মাস আগে ফেরদৌসি জানালা থেকে লাফ দিয়ে গুরুতর আহত হওয়ার পরও আশফাকুল হক এবং তানিয়া খন্দকার কেন সেই জানালার গ্রিল লাগাননি? তারা কি জানতেন না যে এই দুর্ঘটনা একবার যখন ঘটেছে, আবার ঘটতে পারে? তাদের বিরুদ্ধে ফেরদৌসির মা মামলা করার পরও কেন মনে হলো না, ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা আর যেন না ঘটে, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া খুব জরুরি? কেন তাঁরা সমস্যা সমাধানের কোনও উদ্যোগ নেননি? তাঁরা কি ভেবেছেন জানালার গ্রিল লাগানোর দরকার নেই, কারণ যদি কেউ লাফ দেয় জানালা দিয়ে সে তো গরিবেরা দেবে; গরিবদের বেঁচে থাকায় এবং মরে যাওয়ায় তাঁরা হয়তো কোনও পার্থক্য দেখেন না!
আশফাকুল হকদের জামিন নামঞ্জুর হয়েছে। এখনও রায় বেরোয়নি। এখনও জানা যায়নি ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন, প্রীতি উড়াংকে ফেলে দিয়েছিল কেউ নাকি প্রীতি উড়াং পালাতে চেয়েছিল, যদি পালাতে চেয়েছিল কেন পালাতে চেয়েছিল, আর কেউ যদি ফেলে দিয়ে থাকে, কে ফেলে দিয়েছিল এবং কেন ফেলে দিয়েছিল। এসব একদিন হয়তো সকলে জানতে পারবো। কিন্তু তার আগেই আমরা জানি যে দুটো পালাতে চাওয়া এবং ফেলে দেওয়া এই দুটো ঘটনার পেছনে একটি চিত্রই স্পষ্ট, সেটি হলো নির্যাতন। নির্যাতন করে মেয়েকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, অথবা নির্যাতনের কারণে মেয়েটি পালাতে চেয়েছিল। এই নির্যাতন গরিবের ওপর ধনীর নির্যাতন। গৃহকর্মীরা যেহেতু সাধারণত নারী, তাই গৃহকর্মীদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন চলে, তা নারী-নির্যাতনের অংশও, গার্হস্থ্য হিংস্রতার বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অংশও।

একটা সময় ছিল গৃহকর্মীদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করানো হতো, কিন্তু পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না, অথবা দিলেও খুবই নগণ্য পরিমাণে দেওয়া হতো। সেই দিন এখন বদলেছে। প্রচুর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গজিয়ে ওঠার কারণে গৃহকর্মী আগের মতো সহজ লভ্য নয়। গৃহকর্মীর বেতন সে কারণেই আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু গৃহকর্তা আর গৃহকর্মীর মধ্যে যে সম্পর্ক, তা আক্ষরিক অর্থে এখনও প্রভু আর দাসদাসির সম্পর্ক। গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা এখনও ঘটে, গৃহকর্মী হত্যার ঘটনা এখনও ঘটে। প্রীতি উড়াং একা নয়, তার মতো এমন অনেক গৃহকর্মীকে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। এবং আজও হচ্ছে।

গৃহকর্মীরা হামেশাই ধর্ষণের শিকার হয়। যারা বদ গৃহকর্তা, তারা এই অন্যায়টি করে আসছে আদিকাল থেকেই। গৃহকর্মীদের শুধু যে গৃহকর্তারাই নির্যাতন করে তা নয়, গৃহকর্ত্রীরাও করে। প্রশ্ন হলো, কেন গৃহকর্ত্রীরা হঠাৎ এত বর্বর হয়ে উঠল? একসময় মধ্যবিত্ত গৃহকর্তার স্ত্রীও গৃহকর্মী হিসেবে গৃহে বাস করতো। তারাও ছিল বাড়ির দাসি। তাদের কখনও গৃহকর্ত্রী হতে দেওয়া হয়নি। সংসারের কোনও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাদের কোনও অধিকার ছিল না। গ্রামেগঞ্জে বা শহরের ঘরে যে গরিব মেয়েরা কাজ করতো, তাদের সঙ্গে বাড়ির স্ত্রীটির এক ধরনের সখ্য গড়ে উঠতো। দুজনে সুখ-দুঃখের গল্প করতো। দুজনের অসহায়ত্বের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। দুজনই দাসি। গৃহকর্তা দুজনেরই কর্তা। এই চিত্রটি হাওয়া হয়ে যায়নি, এখনও বেশ নেচেখেলেই আছে। কিন্তু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি শহুরে মধ্যবিত্তের ঘরে। মধ্যবিত্তের শান-শওকত কিছুটা বাড়ছে বৈকি। মেয়েরা ইস্কুল কলেজ পাস করছে। বিয়ের পর তাদের এখন গৃহকর্ত্রী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। ঘরকন্নার তদারকি এখন মেয়েদের হাতে। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে সংসারের অনেক ব্যাপারেই। লেখাপড়া জানার, হাতে কলেজ-ডিগ্রি থাকার, গৃহকর্ত্রী বনার, সংসারের ক্ষমতা হাতে পাওয়ার একটা অহংকার এসে ভর করে মেয়েদের গ্রীবায়। তখন তারা সেই আচরণটি করে, যে আচরণ ক্ষমতাবানরা করে, ধনীরা করে-তারা গরিবকে নির্যাতন করে।

এ-ছাড়া অশান্তির সংসার আরেক কারণ। দিনের পর দিন অশান্তির ভেতর ডুবে থাকলে মন মেজাজ দপদপ করে, তখন পান থেকে চুন খসলেই গৃহকর্মীদের শাস্তি পেতে হয়। অশান্তির ক্ষতিপূরণ। যে স্ত্রী মার খায় স্বামীর, সে স্ত্রীই মার দেয় অন্যকে। নিজের চেয়ে দুর্বল, নিজের চেয়ে ক্ষমতাহীন জগতে কেউ যদি থেকে থাকে, সে দাসি। নাগালের মধ্যে আছে বলেই তার ওপর গৃহকর্ত্রী নির্যাতন চালায়, এতে নিজের ক্ষমতা প্রকাশিত হয়, পুষে রাখা ক্রোধও কিছুটা প্রশমিত হয়।

মেয়েরা বর্বরতা জানে না এটা ভাবা খুবই ভুল। মেয়েরা সুযোগ পেলে নিষ্ঠুর, বর্বর, খুনি সবই হতে পারে। বর্বরতা না জানলেও পুরুষের কাছ থেকে বর্বরতা এর মধ্যে শিখে নিয়েছে মেয়েরা। এক পৃথিবীতে, এক সমাজে, এক মহল্লায়, এক বাড়িতে পুরুষের সঙ্গে জীবনভর বাস করছে, আর পুরুষ যা করে, তার কিছুই করতে শিখবে না তারা, এ কেমন কথা? মেয়েরা এখন পুরুষ যা করতে পারে, তার প্রায় সবই করতে পারে। পুরুষের মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে, বৈমানিক, বিজ্ঞানী, কৃষক, শ্রমিক, প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট-সব হতে পারে। এত সব পারে বলেই পুরুষের মতো নির্মমও হতে পারে। আগুনে পোড়াতে পারে গৃহকর্মীদের।

সমতার সমাজ যতদিন না গড়ে উঠবে, যতদিন না ধনী আর গরিবের মাঝে ফারাকটা বা বৈষম্যটা কমবে, ততদিন নির্যাতন চলবে। নির্যাতন চলবে বলে আমাদের কি সব দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল? আমরা কি এখন নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাব? নাকি গরিব আর ধনীর মধ্যে ফারাক থাকুক বা না থাকুক, নির্যাতন যেন না চলে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ যেন করা হয়, সে জন্য সরকারকে চাপ দেব? আমাদের বিবেক বলে যদি কিছু আজও অবশিষ্ট থাকে, তাহলে শুধু সরকারের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে নেব তা তো নয়, যে যার জায়গা থেকে, যে যার সামর্থ অনুযায়ী, কাজ করবো, তাই নয় কি? সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন হওয়ার জন্য উৎসাহিত করবো, গৃহকর্মীদের শ্রমিকের মর্যাদা এবং নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আন্দোলন করবো। এবং একই সঙ্গে সমতার সমাজ গঠনের জন্য উদ্যোগ নেব।

ইচ্ছে করলেই তো মানুষ দরিদ্রের প্রতি সদয় হতে পারে, নিজের ঘৃণ্য দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারে, অন্যের দারিদ্র্য ঘোচাতে সাহায্য করতে পারে, সহমর্মী হতে পারে। ইচ্ছেটাই মানুষ করছে না। বিশেষ করে ধনীরা আর ধনীদের যে শ্রেণি অনুকরণ করতে পছন্দ করে, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

তবে দয়া মায়া মমতা জাকাত সদকা ভিক্ষে ইত্যাদি ঢেলে অগাধ দারিদ্র্য ঘোচানো যায় না। দরিদ্রের প্রতি ঘৃণা যে সমাজে, সে সমাজে ব্যাঙের ছাতার মতো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা গ্রামীণ ব্যাংক তৈরি করেও মানুষের দারিদ্র্য সম্পূর্ণ ঘোচানো যাচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতি, লোভ, হিংসেকে অতিক্রম করার উপায় জানা উচিত। কেউ ধনী হবে, কেউ দরিদ্র থেকে যাবে, এটাকে নিয়ম না ভেবে-দরিদ্র আর ধনীর মাঝখানের ব্যবধানটাকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে সবাইকে। রাজনীতিকরা, ধনীদের যাদের ভূরি ভূরি আছে, তাদের বেজায় খাওয়াচ্ছেন। দরিদ্ররা অভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। ঈশ্বর তাদের অভাবে ডুবিয়ে ইমান পরীক্ষা করছেন, এ রকম একটা হাস্যকর কথা প্রায়ই শুনি। ধনীরা এবং শাসকরা সে কারণে ঈশ্বর এবং ধর্মকে ব্যবহার করেন গরিবদের শান্ত এবং সন্তুষ্ট রাখার জন্য। তা না হলে প্রলেতারিয়েত বিপ্লব ঘটে যাবে এবং তা ঘটে গেলে তো মহামুশকিল।

সোজা বাংলায়, নারীরা কাজের মেয়েকে নির্যাতন করছে। সমাজের এক নির্যাতিত শ্রেণি সমাজের আরেক নির্যাতিত শ্রেণিকে নির্যাতন করছে। এই ছোট নির্যাতন আমাদের চোখে পড়ে, আর বড় নির্যাতন, যেটি ক্ষমতাশালীরা করে, দরিদ্রকে আজীবন দরিদ্র করে রাখার রাজনীতি, সমতার সমাজকে ধারে কাছে ভিড়তে না দেওয়ার ষড়যন্ত্র, সেটি খুব বেশি কারোর চোখে পড়ে না। সেটি যদি চোখে পড়তো, সেটির বিরুদ্ধে যদি যুদ্ধ হতো, তবে প্রীতি উড়াংদের আর মরতে হতো না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights