বর্ষপরিক্রমা আল্লাহর বিধান
আবদুর রশিদ
দিন যায়, মাস যায়, পার হয় বছর। এভাবে একদিন শেষ হয়ে যায় জীবন। বর্ষপরিক্রমা মহান আল্লাহর বিধান। তা সে চান্দ্রবর্ষ হোক, আর সূর্যভিত্তিক হোক। দিনপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার কোথায় প্রথম চালু হয় তা আমাদের জানা নেই। তবে নানা তথ্যপ্রমাণে অনুমান করা হয় ইরাকের ব্যাবিলনে নববর্ষ পালনের প্রথা ছিল ৪ হাজার বছর আগেও। ইংরেজি বা গ্রেগরিয়ান নববর্ষ পালনের ইতিহাস ২০০ বছরের মতো। ইংরেজি দিনপঞ্জি তৈরি হয়েছে সৌরবর্ষ সামনে রেখে। চন্দ্র-সূর্য সবকিছুই যেমন আল্লাহর সৃষ্টি তেমন চান্দ্রবর্ষ বা সৌরবর্ষ- যেভাবেই সময়কে ভাগ করা হোক, সবকিছুর নিয়ন্তা মহান আল্লাহ। সুরা আম্বিয়ার ৩৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ তিনিই যিনি সৃষ্টি করেছেন রাত, দিন, চন্দ্র ও সূর্য। এর প্রতিটিই পরিভ্রমণে নিয়োজিত রয়েছে নিজ নিজ কক্ষপথে, নিজস্ব গতিবেগ সহকারে।’ এ বিষয়ে সুরা ইয়াসিনের ৩৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘সূর্য কখনোই চন্দ্রকে ধরতে পারবে না কিংবা রাত কখনো অতিক্রম করতে পারবে না দিনকে। প্রতিটিই পরিভ্রমণে নিয়োজিত নিজ নিজ কক্ষপথে, নিজস্ব গতিবেগ সহকারে।’ শুভকামনার মাধ্যমে মাসবরণ করা ও বর্ষবরণ করা ইসলামের নীতি, মহানবী (সা.)-এর আদর্শ। রসুলুল্লাহ (সা.) নতুন চাঁদ দেখে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য চাঁদটিকে কল্যাণময়, ইমানদীপ্ত এবং নিরাপত্তা, শান্তি ও ইসলামের বাহন হিসেবে আনয়ন করুন। আমার প্রভু এবং তুমি চাঁদের প্রভু মহান আল্লাহ’ (তিরমিজি)। ইসলাম-পূর্ব মদিনায় নওরোজ (নববর্ষ) মিহিরজান (বসন্ত উৎসব) পালন করা হতো। উকাজ মেলা নামে একটি বিনোদনমূলক উৎসব পালন করার রীতিও প্রচলিত ছিল। মূলত এসব উৎসব ছিল পারস্য সংস্কৃতি। এতে ছিল না মানবতা ও নৈতিকতার কোনো ছোঁয়া। তাই মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘প্রত্যেক জাতির আনন্দ উৎসব আছে। আর আমাদের আনন্দ উৎসব হলো, এই দুই ঈদ’ (সহিহ বুখারি)।
গ্রেগরিয়ান বর্ষবরণ অর্থাৎ পহেলা জানুয়ারি কোনো মুসলমান অন্য কোনো ধর্মের ধর্মীয় রীতিতে অনুসরণ করতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে এ বর্ষবরণ সমগ্র বিশ্বে মুসলিম-অমুসলিম সবার মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বরং বর্ষবরণের এই উৎসব এখন এক ভয়ংকর আতঙ্ক ও কুসংস্কারে রূপ নিয়েছে। এই বছর থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি, ফানুস ওড়ানো এবং অশ্লীলতা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ছিল। দেশের আইন অমান্য করে অনেকেই ওই সব ন্যক্কারজনক কাজে লিপ্ত হয়েছে। ফলে গভীর রাতে রাজধানী ঢাকাকে মনে হয়েছে ভয়ংকর কোনো যুদ্ধক্ষেত্র। হাজারো তরুণ নেশার জগতে অভিষেক করেছে। চরিত্র নষ্ট করার ফাঁদে আবদ্ধ হয়েছে অসংখ্য নারী। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর খলিফার মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ তাঁর হাবিবকে সৃষ্টি করেছেন মানুষের মধ্য থেকে। মানুষের উচিত আল্লাহপ্রদত্ত সময় অর্থাৎ দিন, রাত ও বছরকে তাঁর নির্দেশিত পথে অতিবাহিত করা। এ বিষয়ে গাইডলাইন রয়েছে আল কোরআনের বিভিন্ন সুরায়। সুরা ফাতিহায় সরল পথ পাওয়ার জন্য এবং বিপথগামীদের পথ থেকে রক্ষা পাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ সুরার ৫-৭ আয়াতে আছে, ‘তুমি আমাদের সরল পথ দেখাও, তাদের পথ যাদের তুমি অনুগ্রহ দান করেছ, তাদের পথ নয় যারা ক্রোধে নিপতিত ও পথভ্রষ্ট।’ মানবজাতির সবারই আল্লাহর রহমত যে পথে সে পথ অনুসরণ করা উচিত। দ্বিতীয় সুরা বাকারার তৃতীয় আয়াতে রয়েছে, ‘সৎ জীবিকা থেকে ব্যয় করার আদেশ সৃষ্টিকর্তার।’ এ ব্যাপারটি প্রত্যেক মানুষ মেনে চললে পৃথিবীতে একটি সুষম সমাজ গড়ে উঠবে। সম্পদ বণ্টনে ভারসাম্য হবে। অসৎ উপার্জন থেকে মানুষ বিরত থাকলে পৃথিবীতে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ৪২ নম্বর আয়াতে রয়েছে, ‘মিথ্যার সঙ্গে সত্য না মিশিয়ে ফেলার আদেশ এবং জেনেশুনে সত্য গোপন না করার কথা।’ আল কোরআনের এ ঐশী শিক্ষার সফল বাস্তবায়ন ও চর্চা মানুষকে সঠিক পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করবে এমনটি কাঙ্ক্ষিত। ৪৪ নম্বর আয়াতেই রয়েছে, ‘তোমরা কি মানুষকে ভালো কাজের কথা বল আর নিজেরা ভুলে থাক, আবার কিতাবও পড়? তবু কি তোমরা বুঝবে না?’ অর্থাৎ কোরআন পাঠ করলে ও উপদেশ দিলে হবে না, এর থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যক্তিজীবনে সৎ, সুন্দর হয়ে অন্যদের জন্য উদাহরণ হতে হবে। ৬০ নম্বর আয়াতেই রয়েছে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি না করার উপদেশ। ৮৩ নম্বর আয়াতে ‘এক সৃষ্টিকর্তার ইবাদতের পাশাপাশি শিক্ষা রয়েছে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিনদের প্রতি সদয় হওয়ার আদেশ, মানুষের সঙ্গে সৎভাবে কথা বলার আদেশ।’ আল কোরআনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষকে যেভাবে চলার উপদেশ দিয়েছেন সেভাবে চলার মধ্যে রয়েছে সত্যিকারের জাগতিক ও আখেরাতের শান্তি। আল্লাহ আমাদের আগামী দিনগুলো, বছরের প্রতিটি দিন তাঁর নির্দেশিত পথে চলার তৌফিক দান করুন।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক