মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যা সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে ফেনী জেলায়। কোথাও দাঁড়ানোর মতো জায়গা নেই। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজার জেলাও বন্যাকবলিত হয়েছে। এ জেলাগুলোতে বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হাত বাড়িয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে নৌকা-স্পিডবোট নিয়ে বন্যায় প্লাবিত এলাকার মানুষজনকে উদ্ধারে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। অনেকে কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, পিকআপ ভরে নিয়ে যাচ্ছেন শুকনো খাবার, জরুরি ওষুধ, নিরাপদ পানি, চাল-ডাল। কিছু জায়গায় বানভাসিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে নগদ অর্থ। আবার বন্যার্তদের সহযোগিতায় অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মীরা একদিনের বেতন দান করেছেন। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে দাতা প্রতিষ্ঠানে সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা পৌঁছে দিতেও দেখা গেছে অনেককে। যে যার জায়গা থেকে যেভাবে পারছেন সেভাবেই দাঁড়াচ্ছেন বানভাসি মানুষদের পাশে।

সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন সাধারণ মানুষও। এর সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল, সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও ফান্ড সংগ্রহ করছেন বানভাসিদের সাহায্যার্থে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) গণত্রাণ সংগ্রহ করছে। তারা বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করেছেন এবং বন্যা কবলিত এলাকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাদের আহ্বানে মানুষ ব্যাপক সাড়াও দিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই কয়েকদিনে প্রচুর খাদ্যসামগ্রী, পোশাক, স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং প্রায় ১৫ লাখ টাকা সংগৃহীত হয়েছে। গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচিতে ৬ বছরের ছোট্ট ইহান নিয়ে এসেছেন ৩ বছর ধরে জমানো সব টাকা। পুরো প্লাস্টিকের ব্যাংকই তুলে দিয়েছেন বানভাসি মানুষের সহযোগিতার জন্য। এমন অনেকেই যার যার অবস্থান থেকে দাঁড়িয়েছেন বন্যার্তদের পাশে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মেডিকেল টিমের সমন্বয়ক আবদুল মুনঈম বলেন, সাধারণ জনতার এমন একতাবদ্ধ প্রয়াস আগে কখনো দেখা যায়নি। সবাই নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। আমরা মানুষের এমন সাড়ার ব্যাপারে অবাক হয়েছি। মনে হচ্ছে, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। এটি আমাদের প্রথম পরীক্ষা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস সবাই মিলে একসঙ্গে এই পরীক্ষা জয় করব।

ভয়াবহ ও আকস্মিক এই বন্যায় ১৫টিরও বেশি জেলায় তৈরি হয়েছে মানবিক বিপর্যয়। এমন অবস্থায় বানভাসি ও বন্যাকবলিত মানুষদের পাশে সামর্থ্য অনুযায়ী দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন মসজিদের খতিবরা।

এবার বন্যা ঘিরে সম্প্রীতির এক নতুন নজির সৃষ্টি করেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও। তাদের দুর্গোৎসব আয়োজনের বাজেট থেকে বন্যাদুর্গতদের অর্থ সহায়তা পাঠিয়েছে দেশের বেশ কয়েকটি মন্দির কমিটি। আরও কয়েকটি কমিটি সহায়তা পাঠাতে তহবিল প্রস্তুত করেছে বলে জানা গেছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম-অঙ্গসংগঠন ইতোমধ্যে সামগ্রী ও উদ্ধারযান নিয়ে বন্যাকবলিত এলাকায় গেছেন। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি শিল্পী সমাজও বন্যাকবলিত এলাকার মানুষকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন স্ট্রিমার, কেউ নগদ টাকা, কেউ খাদ্যসামগ্রী, কেউ দিয়েছেন জামাকাপড়। বন্যার্তদের সহযোগিতায় ১ দিনের বেতন দিচ্ছেন অনেকেই। সরকারি, বেসরকারি চাকরিজীবীরাও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে এক দিনের বেতনভাতা দিয়েছেন। বন্যার্তদের সহযোগিতায় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনীর সব পর্যায়ের সদস্যরাও। এ ছাড়া আরও সরকারি, বেসরকারি অফিস এবং স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গঠন করা হয়েছে ত্রাণ তহবিল।

বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ফ্রি টকটাইম এবং ইন্টারনেট সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে দেশের মোবাইল অপারেটররা। সবার আগে তারাই বন্যার্তদের জন্য সহযোগিতামূলক উদ্যোগ নিয়েছে। সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য-সহায়তা করার জন্য অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন। আর বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই মহতী আগ্রহকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও স্বাগত জানানো হয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তিরা প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে সহায়তার অর্থ পাঠাতে পারবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights