সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানসহ ১৩ পুলিশ কর্মকর্তা বিরুদ্ধে মামলা

ঢাকার খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুজ্জামান জনিকে প্রায় দশ বছর আগে ‘ক্রসফায়ারের নামে হত্যার’ অভিযোগে সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ ১৩ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তার বাবা মো. ইয়াকুব আলী।

মঙ্গলবার ডিএমপির খিলগাঁও থানায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ৪৯ নেতাকে। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

জনি খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হন। এর আগে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। জনি হত্যার ঘটনায় সাড়ে নয় বছর পর তার বাবা ইয়াকুব আলীর মামলা করলেন।
মামলায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা হলেন— ডিএমপির তৎকালীন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ডিএমপি ডিবির সাবেক উপ পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, খিলগাঁও থানার এসআই মো. আলাউদ্দিন, ডিবি রমনা জোনের এসআই দীপক কুমার দাস, ডিবির রমনা জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার হাসান আরাফাত, মো. জাহিদুল হক তালুকদার, ডিবির পুলিশ পরিদর্শক ওহিদুজ্জামান, এস এম শাহরিয়ার হাসান, ডিবির এসআই শিহাব উদ্দিন, বাহাউদ্দিন ফারুকী, মো. জাহাঙ্গির হোসেন, ডিবির কনস্টেবল মো. সোলাইমান ও আবু সায়েদ।

মামলার অন্যতম আসামি আছাদুজ্জামান মিয়া ডিএমপি কমিশনার থাকার সময় শুধু ক্রসফায়ারের নামে জনি হত্যায় নয, বিএনপিসহ আওয়ামী লীগের বিরোধী রাজনৈতিক মতের বহু নেতাকর্মীকে গুম-খুনের অভিযোগ রয়েছে। তৎকালীন আওয়ামী সরকারের আজ্ঞা পালনে তিনি কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করতেন না। তার সময়ে ঢাকা মহানগর পুলিশকে রীতিমতো দলীয় বাহিনীতে পরিণত করার অভিযোগও রয়েছে।

আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার স্ত্রী ছেলে মেয় এবং স্বজনদের নামে বেনামে দেশে বিদেশে অনেক সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। সাবেক এ উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর লাপাত্তা মহাদুর্নীতিবাজ হিসেবে খ্যাত আছাদুজ্জামান মিয়া। এরইমধ্যে ফরিদপুরে তার দখলে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধার জমি উদ্ধার হয়েছে। রাজধানীর নিকুঞ্জে তার ছোট ছেলের নামের বিলাসবহুল বাড়িতে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা হামলাও চালিয়েছে।

জনির বাবার মামলায় আসামি আওয়ামী লীগ নেতারা হলেন— ঢাকা-৯ আসনের সাবেক এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী, তার এপিএস আব্দুল মান্নান, খিলগাঁও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি শরীফ আলী খান, মাহবুব হোসেন মাহবুব, ওযাহিদুল হাসান মিল্টন, নেছার উদ্দিন আহমেদ কাজল, নুরুজ্জামান জুয়েল, মোদাচ্ছের হাওলাদার, আব্দুল আজিজ, আব্দুল জলিল ওরফে ফর্মা জলিল, শাহাদাত হোসেন সাদু, ওহিদুল হাসান টফি, তানজির হাসান, সিরাজুল ইসলাম শাহিন, তাওহীদ, রাজিব, মো. ইব্রাহিম, আব্দুল হামিদ বাবু, সোহেল ব্যাপারি, মো. পলাশ, মো. সম্রাট, মো. লুৎফুর কবির শাওয়ান, আতাউর রহমান, মো. অপু, মো. খোকন, মো, রিপন, মো. স্বপন, মো. সালেহ উদ্দিন মৃধা, মো. মনির হোসেন, মো. মনির হোসেন মোল্লা, মো. জুয়েল, মো. আব্দুল্লাহ আল মতিন মার্শাল, মো. ময়েনউদ্দিন মিলন, মো. ওমর আলী মাস্টার, মো. মোস্তাফিজুর রহমান, মো. আনিছুল রহমান সরকার, মো. মুকিতুল হক তুর্য, মো. জহুরুল ইসলাম ভুট্ট, ডিস সোহাগ, ব্রজেন দাস, ফর্মা সুজন, মো. শাহফুদ্দিন মজুমদার, মো. গোলাম বাপ্পি ওরফে পিচ্চি রুবেল, মো. রুহুর আমিন, মো. নঈম হোসেন ভূইয়া, মো. ফরহাদ হোসেন ভূইয়া, মো. সাহাবুদ্দিন, মো. নজরুল ইসলাম ও মো. গোলাম মোস্তফা ওরফে বাবড়ী মোস্তফা।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ১৯ জানুযারি সকাল আনুমানিক ৮টা ১৫ মিনিটের দিকে নূরুজ্জামান জনি ও তার সহপাঠি মইনসহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছোট ভাই মনিরুজ্জামান হীরাকে দেখতে যায়। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফেরার পথে আসামিরা জনি ও মইনকে ডিবি পরিচয় দিয়ে অবৈধভাবে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্যাতন চালায়। পরবর্তীতে তাদেরকে ডিবি ঢাকা মেট্রোপলিটন-দক্ষিণ কার্যালয়ে নিয়ে গিয়েও নির্যাতন চালায়।

এরইমধ্যে বাদী এবং ভিকটিম নুরুজ্জামান জনির ৭ (সাত) মাসের অন্তঃসত্তা স্ত্রী মুনিয়া পারভিনসহ আত্মীস্বজনরা খিলগাঁও থানা, ডিবি দক্ষিন অফিস, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অফিসসহ বিভিন্ন থানায় হন্য হয়ে খুঁজে বেড়ায়। আসামিরা জনিকে আটক করেননি বলে জানান। প্রায় ২ দিন ধরে খোঁজাখুজি করার পরেও নুরুজ্জামান জনির কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

পরবর্তীতে ২১ জানুযারি রাত আনুমানিক ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে খিলগাঁও থানাধীন জোড়াপুকুর খেলার মাঠের আশপাশের মানুষ নির্যাতনের ফলে কান্না ও চিৎকার করা কন্ঠ শব্দ শুনতে পায়। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে নির্যাতিত ব্যক্তিটি পানি-পানি বলে চিৎকার ও মা-মা বলে আর্তনাদ করতে থাকে।

ঘটনাস্থলের এলাকার পাশে সি-ব্লকের বাসিন্দা লাভলী বেগম রাতের কান্নার শব্দ শুনেছে বলে জানান। এ-ব্লকের বাসিন্দা সাইফুদ্দিনের স্ত্রী সানজিদা আক্তার সেতু জানান, রাত ৩টার দিকে ওমাগো, মা, মা.. বাঁচাও বলে কয়েকবার চিৎকার শুনেছেন।

সেই সময় আশপাশ এলাকার বাসিন্দারা গুলির শব্দ শুনতে পায়। ভোর রাতে বাদীসহ সাক্ষীগণ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা খিলগাও খানাধীন জোড়াপুকুর মাঠের দিকে গিয়ে পুলিশদের দেখতে পায়। আসামিরা বলে যে, নুরুজ্জামান জনি পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে। তাহার মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে।

বাদী ও সাক্ষীগণ ঢাকা মেডিকেল মর্গে যায় এবং সেখানে গিয়ে দেখে নুরুজ্জামানের বুকের বামে, ডান দিকে, দুই হাতের তালু ও করিতে ১৬টি গুলির চিহ্ন সমস্ত শরীর ঝাঁজরা করে ফেলেছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায়। উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জিজ্ঞাসা করলে তারা কর্কশ ভাষায় গালিগালাজ করে। লাশ গ্রহণ না করলে মামলা দেওয়ার হুমকি দেয়।

এজাহারে বলা হয়, আসামিরা ২০১৫ সালের ১৯ জানুযারি ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত বেআইনিভাবে হেফাজতে রেখে নির্যাতন ও গুলি করে ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে নির্যাতন ও নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।

আরও বলা হয়েছে, পুলিশী হেফাজতে নিহত ভিকটিম নুরুজ্জামান জনির পিতা অভিযুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করতে থানায় গেলে তাকে মিথ্যা মামলা এবং ক্রস ফায়ারের ভয় দেখানো হয়। এছাড়া আসামিগণ দীর্ঘদিন বাদীকে এবং তার পারিবারকে ভয়ভীতি দেখানোর কারণে থানায় হত্যা মামলা রুজু করতে পারেননি। তাই বিলম্বে মামলা দায়ের করা হলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights