আওয়ামী লীগের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই
সাক্ষাৎকার :
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশে নানামুখীতৎপরতা চলছে। বিএনপি এক দফা দাবিতেআন্দোলন করছে। অবাধ ও সুষ্ঠুনির্বাচনের প্রত্যাশা জানাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। এ নিয়েআমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীহারুন-অর-রশিদ।
প্রশ্ন : নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে।রাজনীতি ও কূটনীতির ক্ষেত্রেনানামুখী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশেররাজনীতি আসলে কোন দিকেযাচ্ছে?
হারুন-অর-রশিদ : বাংলাদেশেররাজনীতি দুটি পরস্পরবিরোধী আদর্শিকধারায় বিভক্ত। আর এর রূপটিহচ্ছে সাংঘর্ষিক। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনেরেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দ্বন্দ্বের ধারাআমরা দেখছি, এটি নতুন কিছুনয়। এর শুরু অনেকআগে। বিশেষ করে, ১৯৭১ সালেরমহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭৫ সালেবঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীএকটি ধারার সূত্রপাত ঘটে। কাজেই মুক্তিযুদ্ধেরপক্ষের ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী—বড় পরিসরে, এইদুই ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে আমাদেররাজনীতি, সমাজ, এমনকি নাগরিক সমাজও। নির্বাচন এলে দুই ধারারপরস্পরবিরোধী অবস্থান আরো তীব্র হয়।এর কারণ হলো নির্বাচনেরমাধ্যমে একটা সরকার পরিবর্তনেরসম্ভাবনা থাকে। রাজনীতির এই দ্বান্দ্বিক রূপনির্বাচন সামনে রেখে আরো ঘনীভূতহয়।
প্রশ্ন : পশ্চিমাদেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রত্যাশারকথা জানাচ্ছে। বিবৃতি দিচ্ছে। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের এতআগ্রহের কারণ কী বলেআপনার মনে হয়?
হারুন-অর-রশিদ : এবারেরনির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাষ্ট্রও সংস্থা যেভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছে এবং উৎসাহ দেখাচ্ছেকিংবা অন্যভাবে বললে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, এটি আগে এইমাত্রায় ছিল না। প্রশান্তমহাসাগর ও ভারত মহাসাগরঅঞ্চলকে কেন্দ্র করে পরাশক্তিগুলোর, বিশেষকরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করারযে উদ্যোগ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ তার মধ্যে পড়েছে।আসলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতিক গুরুত্বঅনেক বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রএ অঞ্চলের যে রাষ্ট্রগুলোকে নিয়েএকটি সাপোর্ট বেজ বা সমর্থকবলয় গড়ে তুলতে চায়, তা
প্রশ্ন : অবাধ ও সুষ্ঠুনির্বাচনের বিষয়ে চাপ সৃষ্টির আড়ালেপশ্চিমাদের অন্য কোনো স্বার্থআছে?
হারুন-অর-রশিদ : বাংলাদেশেযে অবাধ ও সুষ্ঠুনির্বাচনের কথা বলছে এটিতাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। এর আড়ালে তাদেরনিজস্ব এজেন্ডা আছে। আর সেটিহলো বাংলাদেশকে তাদের বলয়ে রাখা। ভারতআমাদের তিন দিক থেকেআছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খাঁটি। এ সম্পর্ক এতবিশাল ও ঐতিহাসিক যেএটি নিয়ে আর বিতর্কেরসুযোগ নেই। এই সম্পর্কঅব্যাহত থাকবে। এর বাইরে চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন—সবাই চাচ্ছে বাংলাদেশতাদের সমর্থন বলয়ের মধ্যে থাকুক। পশ্চিমারা চাচ্ছে বাংলাদেশ কোনোভাবেই যেন চীনের দিকেঝুঁকে না পড়ে। পশ্চিমাদেরএজেন্ডা হলো, বাংলাদেশ ১৭কোটি মানুষের দেশ, বিকাশমান বাজার।এখানে বিনিয়োগের সুযোগ আছে। এখানে আরোবেশি করে আসার সুযোগআছে। ফলে একে তাদেরবলয়ে রাখতেচায় তারা।
প্রশ্ন : পশ্চিমা দেশগুলো তো এ দেশেমানবাধিকার, আইনের শাসন নিয়েও কথাবলে।
হারুন-অর-রশিদ : যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোঅবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনেরকথা বলে। একদিকে তারাআইনের শাসনের কথা বলে। আবারযখন তাদের পছন্দের কারো ব্যাপারে আইনেরপ্রয়োগ করা হয় তখনতারা ক্ষুব্ধও হয়। যেমন : অধিকারেরসম্পাদক আদিলুর রহমান খানের বিচার। তিনি দীর্ঘ বিচারিকপ্রক্রিয়ায় শাস্তি পেয়েছেন। এই বিচার নিয়েওযদি তারা কথা বলেতাহলে বুঝতে হবে, তারা এদেশে আইনের শাসন, বিচারব্যবস্থাকে শ্রদ্ধা করে না। মার্কিনপ্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলেহান্টার বাইডেন অস্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কারাগারে যেতে হয়েছে। এরকারণ আইনের শাসন ও আইনেরঊর্ধ্বে কেউ নন। বাংলাদেশেযদি কেউ আইন লঙ্ঘনকরে, অসত্য প্রচার করে, তাহলে সেআইনের আওতায় আসবে—এটাই তোস্বাভাবিক। সেখানে বিচারের পর রায় নিয়েযদি প্রশ্ন তুলে বিবৃতি দেয়, তাহলে এটি তাদের দ্বিমুখীও পরস্পরবিরোধী অবস্থান। আসলে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোরজবাবদিহি নেই। তারা বিভিন্নসময় বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। অনেকসময় তারা পরস্পরবিরোধী ভূমিকায়অবতীর্ণ হয়। মূল বিষয়হলো শক্তি।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ তাহলে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের চাপে আছে?
হারুন-অর-রশিদ : ১৯৭১সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশেরবিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। আমাদেরবিজয় তারা ঠেকাতে পারেনি।আমরা বিজয়ী হয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে এসেছিল। এ দেশের মানুষেরইচ্ছা ও অভিপ্রায়ই এখানেজয়ী হবে। বিদেশি সবচাপ বাস্তবে কাজ করবে না।বিশ্বরাজনীতি, মেরুকরণের মধ্যেও বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতির মূলবিষয়—সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, এটা অনুসরণকরছে।
প্রশ্ন: আবার দেশের রাজনীতিনিয়ে কথা বলি। বিএনপিকি নির্বাচনে আসবে বলে মনেকরেন?
হারুন-অর-রশিদ : বিএনপিযে শক্তিগুলোর বা দেশগুলোর ভরসাকরছে, তারাও বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে পরামর্শ দেবে।অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা দেশের ভেতর ও বাইরে—দুই জায়গায়ই সৃষ্টিহয়েছে। সরকারেরও এর বাইরে যাওয়ারসুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রেওই দেশগুলো হয়তো বলবে, নির্বাচনেযাও। আমরা তো পর্যবেক্ষকেরভূমিকা পালন করছি। এটিএকটি বিষয়। অন্যটি হলো, নির্বাচনে নাএসে বিএনপির টিকে থাকা খুবকঠিন। আমার মনে হয়, বিএনপি নির্বাচনে আসবে। এতে করে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনহবে। আর তারা যদিবর্জন করে, করতে পারে।কিন্তু নির্বাচন যদি প্রতিহত করতেহয় তখন তো নির্বাচনেভোটার উপস্থিতি, ভোট কম হবে।দেখার বিষয় বিএনপি কোনঅবস্থান নেয়। তবে এবার২০১৪, ২০১৮-এর চেয়েভিন্ন একটা নির্বাচন হবে।বাংলাদেশের মতো দেশে নির্বাচনকমিশন গত কয়েক মাসেযে নির্বাচনগুলো করেছে সেগুলো তো সুষ্ঠু হয়েছে।তারা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় সক্ষম। সেখানে আমরা নির্বাচনের দিকেইযাচ্ছি।
প্রশ্ন : বিএনপি তো অক্টোবরে চূড়ান্তআন্দোলনের কথা বলছে।
হারুন-অর-রশিদ : বিএনপিআবার বলছে, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করবে। তারা তো দিনক্ষণবেঁধে দিয়েছিল। ১০ ডিসেম্বর। সংসদথেকে পদত্যাগ করল। চার বছরসংসদে থাকার পর পদত্যাগ করেআবার বলছে অবৈধ সংসদ।তাহলে তারা চার বছরথাকল কিভাবে? অন্যদিকে ছয়জন শপথ নিলেন।মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নিতে পারলেননা কেন? কারণ সিদ্ধান্তলন্ডন থেকে আসে। যেখানেসিদ্ধান্ত লন্ডন থেকে আসে সেখানেতিনি প্রক্সি দেন। তাঁর তোনিজস্ব কোনো সত্তা নেই।
প্রশ্ন : আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনোধরনের ছাড় দেওয়ার সুযোগআছে? ছাড় দেওয়া উচিতবলে আপনি মনে করেন?
হারুন-অর-রশিদ : তত্ত্বাবধায়কসরকার ব্যবস্থাকে বিএনপিই বিতর্কিত করেছে। আমি মনে করিনা আওয়ামী লীগের বিএনপিকে ছাড় দেওয়ার আরকোনো সুযোগ আছে। বিএনপি এরইমধ্যে এক দফার আন্দোলনেচলে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্বাচনকমিশন বাতিল—এটা কিভাবে তারাঅর্জন করতে পারে? কোনোক্ষমতাসীন দল স্বাভাবিকভাবে এটিকরার কথা না। তারাসংবিধানের বিরুদ্ধে যাবে? বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও এটা করত না।দ্বিতীয়ত, বিএনপি ও অন্য দলগুলোএক দফার আন্দোলনে গিয়েইস্যুভিত্তিক আলোচনার সুযোগও শেষ করে দিয়েছে।এক দফার আন্দোলন নাকরে তারা যদি আলোচনারদরজা খোলা রাখত তাহলেনির্বাচন কিভাবে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও আরো অংশগ্রহণমূলককরা যায় সে বিষয়েআলাপ-আলোচনা হতে পারত।
প্রশ্ন : এই সুযোগে অন্যকোনো শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা কি আছে?
হারুন-অর-রশিদ : শীতলযুদ্ধ যখন ছিল তখনবিভিন্ন দেশে সেনা অভ্যুত্থানঘটত। ২০১৪ সালে বিরোধীদল চেয়েছিল সেনা হস্তক্ষেপ ঘটুক।সেটি কিন্তু ঘটেনি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতেকেউ যদি অবৈধ পন্থায়বা অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখল বা তারষড়যন্ত্র করে কিংবা তারসঙ্গে যুক্ত থাকে তবে এরসর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরা আছে। তাই সার্বিকদিক বিবেচনা করলে সেনাবাহিনী বাঅসাংবিধানিক কোনো শক্তির ক্ষমতাদখলের চেষ্টা—এর সম্ভাবনা আমিআর দেখি না। তাহলেদাঁড়াল, নির্বাচনের দিকেই আমরা অগ্রসর হচ্ছি।সংবিধান অনুযায়ী, বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে থাকবে। এই নির্বাচন কমিশনইনির্বাচন পরিচালনা করবে।
প্রশ্ন : দলগুলোর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে বিদেশিরা অনেকসময় জানতে চান। ভবিষ্যতে বড়দুটি দলের নেতৃত্বে কারাআসতে পারে বলে আপনারধারণা?
হারুন-অর-রশিদ : বিএনপিনেতৃত্ব নিয়ে সংকটে পড়বে।আসলে এ বিষয়টি আরোদেখতে হবে। তবে রাজনৈতিকআদর্শ সংকট, নেতৃত্বসংকট—দুটিই বিএনপির এখনই আছে।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব?
হারুন-অর-রশিদ : প্রধানমন্ত্রীজি২০-এ যাঁদের সঙ্গেনিয়ে গেছেন, সেলফি তুলেছেন, পাশে রেখেছেন। এটিমনে হয় ভবিষ্যতের জন্যএকটি বার্তা।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ