স্বর্ণ ছিনতাইয়ে অন্যরকম ঐক্য

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

সিলেটে একজোট হয়ে স্বর্ণ ছিনতাই করছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মী। দিনে রাজপথে ভিন্ন ব্যানারে থাকলেও রাতে তারা একজোট হয়ে নামেন ছিনতাইয়ে। তাদের মিশন থাকে টার্গেটকে শিকারে পরিণত করা। সম্প্রতি এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ১৪০ ভরি সোনা ছিনতাইয়ের পর ওই চক্রের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ছিনতাইয়ের ঘটনায় দুজন গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকেও ওই চক্রের সদস্যদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। ছিনতাইয়ের অন্তত এক মাস আগে ওই চক্রের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী বা ব্যক্তির পেছনে সোর্স লাগিয়েছিলেন। আর তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে সম্পন্ন করে ‘অপারেশন’।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী সিলেট থেকে পুরনো স্বর্ণালংকার কেনেন। সিলেটে মেশিন দিয়ে আধুনিক ডিজাইনের স্বর্ণালংকার তৈরির সুবিধা কম থাকায় তারা সেগুলো ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। ঢাকা থেকে স্বর্ণালংকার তৈরি করে নিয়ে আসেন সিলেটে। ঢাকায় নিয়ে যাওয়া-আসার পথে ওই চক্রের সদস্যরা স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়।

সূত্র জানায়, ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ছিনতাই করে থাকে। একটি গ্রুপ থাকে লালদীঘিরপাড়ের স্বর্ণ মার্কেটে। ওই গ্রুপের সদস্যদের কেউ কেউ আবার সেখানকার স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী ও কারিগরের কাজ করে থাকে। যে ব্যবসায়ী ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বর্ণ কিনে মজুদ করেন তাকে নজরদারিতে রাখে মার্কেট গ্রুপের সদস্যরা। কোন দিন কার মাধ্যমে ওই স্বর্ণ ঢাকায় যাচ্ছে সে তথ্য মূল গ্রুপকে জানায় মার্কেট গ্রুপ। ছিনতাইয়ের দিন মূল গ্রুপ স্বর্ণের ক্যারিয়ারকে (বাহক) পাহারায় রাখে। স্বর্ণ নিয়ে বের হওয়ার পর মোটরসাইকেল নিয়ে তার পিছু নেয়। বাহক নিরিবিলি স্থানে পৌঁছলে আগে থেকে তথ্য পেয়ে যাওয়া মূল গ্রুপের সদস্যরা স্বর্ণের চালান ছিনিয়ে নিয়ে মোটরসাইকেল কিংবা গাড়িতে পালিয়ে যায়। এক্ষেত্রে ছিনতাইয়ের নিরাপদ স্থান হিসেবে ছিনতাইকারীরা হযরত শাহজালাল (রহ.) ব্রিজ ও কিন ব্রিজকে বেছে নেয়। ব্রিজে সিসি ক্যামেরা না থাকায় তারা নিরাপদে ছিনতাই করে পালাতে সক্ষম হয়। গত ১৯ জুলাই রাতে কিন ব্রিজের ওপর থেকে সিলেট নগরীর বন্দরবাজারের রহমান ম্যানশনের জয় জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ ঘোষের ১৪০ ভরি স্বর্ণ ছিনতাই হয়। স্বর্ণগুলো নিয়ে ঢাকার যাচ্ছিলেন প্রদীপ ঘোষের দোকানের কর্মচারী পলাশ সরকার। রাত পৌণে ১২টার দিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় কদমতলী বাস টার্মিনালে যাওয়ার পথে কিন ব্রিজের ওপর ৬-৭টি মোটরসাইকেলযোগে একদল ছিনতাইকারী এসে পলাশকে মারধর করে ১৪০ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ২৪ জুলাই কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন প্রদীপ ঘোষ।
তদন্তে নেমে পুলিশ এ ঘটনায় ছিনতাইকারী চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন- নগরীর ছড়াপাড়ের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন কালা ও বন্দরবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী সুদীপ বণিক। ইসমাইল এর আগে বন্দরবাজারের স্বর্ণ মার্কেটে কাজ করত। গত বছর নগরীর উপশহরে একটি স্বর্ণ ছিনতাই মামলার আসামি হওয়ার পর সে চাকরিচ্যুত হয়। আর সুদীপ বণিক চোরাই স্বর্ণ কিনে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। ওই ছিনতাই ঘটনায় ছয়জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই নিশু লাল দে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ছিনতাই ঘটনায় ১৬ জন জড়িত ছিল। ছিনতাইয়ে জড়িতদের ফোনের কথোপকথন রেকর্ড ও গ্রেফতারের পর দেওয়া তথ্যমতে জানা যায়, ছিনতাইয়ের জন্য অনেক দিন আগ থেকে তারা ব্যবসায়ী প্রদীপ ঘোষকে টার্গেট করেছিল। স্বর্ণের চালানের বাহককে নজরদারি, তথ্য আদান-প্রদান ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে ছিলেন- ছাত্রলীগের মাছুম, হোসাইন ও রিফাত এবং ছাত্রদলের সুমন, আবীর ও মিজান। এ ছাড়া ছিনতাইয়ে জড়িত ছিল- বোরহান, শাহীন, লিমন, ইসমাইল হোসেন কালা, পাগলা রুবেল, ফাহিম, মামুর, সায়েম ও শহীদ আলী। এদের বেশির ভাগই ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িত। কাউকে নেতা হিসেবে আবার কাউকে কর্মী হিসেবে নিজ নিজ দলের কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা গেছে। তবে ছিনতাইয়ের মূল নেতৃত্বে ছিল সুমন, বোরহান ও শাহীন। বোরহান আগে ছিনতাইয়ের শিকার ব্যবসায়ী প্রদীপ ঘোষের দোকানে চাকরি করত। তবে আদালতে জমা দেওয়া চার্জশিটে ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর নগরীর উপশহরে সৌদি আরবফেরত এক প্রবাসীর কাছ থেকে দুটি স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নেয় ওই চক্রের সদস্যরা। ওই ঘটনায় যাদের আসামি করা হয় তাদের অনেকেই প্রদীপ ঘোষের ১৪০ ভরি স্বর্ণ ছিনতাই ঘটনায়ও জড়িত ছিল বলে সূত্র জানিয়েছে। সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ জানিয়েছেন, ছিনতাইকারীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকা ধরে অভিযানও হচ্ছে। অপরাধী কেউই ছাড় পাবে না। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যা করণীয় সবকিছু করবে পুলিশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *