‘বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও কমেছে রেমিট্যান্স পাঠানোর হার’

চলতি বছরের গত ১১ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ১০ লাখ ২৯ হাজার ৫৪ জন বাংলাদেশি। এরমধ্যে নারী কর্মীর সংখ্যা ৯৯ হাজার ৬৮৪ জন। তবে এই সংখ্যা গত বছর ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন। কর্মী পাঠানোর সংখ্যা বাড়লেও কমেছে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ। চলতি বছরের গত নভেম্বর পর্যন্ত রেমিট্যান্স আসছে ১৯.৫৮ বিলিয়ন। যা গত বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ১৭ % কম।

বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসনের গতি-প্রকৃতি ২০২২ অর্জন এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এসব তথ্য তুলে ধরেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী।

রামরু আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রামরু প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মেরিনা সুলতানা, প্রজেক্ট ম্যানেজার নুসরাত মাহমুদ, রাবেয়া নাসরিন ও গবেষণা সহায়ক আনিকা তাবাসসুম প্রমুখ। ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, গত ১১ মাসে যে সংখ্যক কর্মী বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছে তা ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে অভিবাসন প্রবাহ ৮১ দশমিক ৮৮ শতাংশ বাড়বে গত বছরের তুলনায়। চলতি বছরের ১১ মাসে নারী কর্মী গমনের সংখ্যা ৯৯ হাজার ৬৮৪ জন। যা গত বছর গেছেন ৮০ হাজার ১৪৩ জন। চলতি বছর সে সংখ্যক নারী কর্মী বিদেশ গেছেন ডিসেম্বর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকলে গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশে।
তিনি বলেন, এবারও সবচেয়ে বেশী কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। সেখানে গত ১১ মাসে গেছেন ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৫০৭ জন। যা মোট অভিবাসনের ৫৬ শতাংশ। এরপর গেছেন ওমানে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৪৮ জন। যা মোট অভিবাসনের ১৫ শতাংশ। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন ৯৪ হাজার ৫৮৯ জন, সিঙ্গাপুরে ৫৯ হাজার ১৩১ জন, মালয়েশিয়া ২৭ হাজার ৮০০ জন এবং কাতারে গেছেন ২২ হাজার ১৮৬ জন।

এদিকে নারী কর্মীদের মধ্যেও চলতি বছরের ১১ মাসে ৬৬ হাজার ৩৩ জন গেছেন সৌদি আরবে। যা মোট জনশক্তি রপ্তানির ৬৬ শতাংশ। আরো নারী কর্মী গেছেন ওমানে ১৫ হাজার ৭৫৯ জন, জর্ডানে ১১ হাজার ৭৬২ জন, কাতারে ১ হাজার ৮৮৩ জন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ হাজার ৫৮৯ জন কর্মী। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি ১২ থেকে ১৩টি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটা বাড়াতে হবে। এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় বেশি সংখ্যক কর্মী পাঠানো গেছে। আবার তিন চার বছর পর মালয়েশিয়া ও বাহরাইনের শ্রমবাজার খুলছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এবার সবচেয়ে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, চাঁদপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, ঢাকা ও নরসিংদী থেকে বেশি কর্মী গেছেন। দক্ষতার দিক থেকে এবারও কম দক্ষকর্মী গেছেন। গত বছরের চেয়ে চলতি বছরে দক্ষ কর্মী কম পাঠানো গেছে যা ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। যা গত বছর ছিল ২১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। যা এবার ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ কম। এ প্রসঙ্গে অভিবাসন নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, এখনো সিংহভাগ কর্মী যায় ব্যক্তিগত ভিসায়। কখনো আত্মীয়স্বজন কিংবা পাড়া প্রতিবেশি যারা বিদেশে কর্মরত তাদের মাধ্যমে পাওয়া ভিসা ব্যবহার করে বিদেশ যাচ্ছেন। ফলে সেখানে দক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না।

তিনি বলেন, দক্ষ কর্মী পাঠাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বেশ কিছু প্রকল্প চলমান। রিক্রুটিং এজেন্সি বা সরকারের মাধ্যমে কর্মী পাঠানো গেলে দক্ষতা নিয়ে কর্মীরা বিদেশ যেতে পারতেন। আর দক্ষ কর্মী পাঠানো গেলে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ বাড়তো।

এদিকে, এবার রেমিট্যান্স কম এসেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। এবার মোট রেমিট্যান্স আসছে ১৯ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। যা গত বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। এ বিষয়ে ড. তাসনিম বলেন, কর্মী কিন্তু বেশি গেছে অন্তত গত বছরের চেয়ে। কিন্তু সে তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে। অথচ ডলারের দাম বাড়তি, সেখানে কিন্তু রেমিট্যান্স বাড়ার কথা। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ঠিক রাখতে প্রণোদনা অন্তত ১০ শতাংশ বাড়ানো উচিত। ট্যাক্স পলিসির ভুল সংশোধন করতে হবে, যে কারণে হুন্ডি আমদানি বাড়ে। হুন্ডি অপারেটররা সুযোগ নেবে এটা বন্ধ করতে হবে।

গত ১১ মাসে বিদেশে যাওয়ার সংখ্যার পাশাপাশি ফিরে আসার সংখ্যাও কম ছিলো না। বিশেষ করে তিন হাজারের মত কর্মীর লাশ এসেছে। এদিকে নজর দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, এবার ৮১ শতাংশ অভিবাসন বেড়েছে এটা অনেক বড় বিষয়। কিন্তু রেমিট্যান্স সে তুলনায় আসছে না। সেটা কেন? এটা খুঁজে বের করা দরকার। সংশ্লিষ্ট ফোরামগুলোর সঙ্গে কথা বলতে হবে। অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ন্যয় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তিনি এসময় দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির ওপরে গুরুত্ব দেন। জনশক্তি রপ্তানিতে সিন্ডিকেট উদঘাটন করে জনসমুক্ষে তুলে ধরার কথা বলেন। বিদেশে অভিবাসীর মৃত্যুকে দুর্ভাগ্যজনক উল্লেখ করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো, সেজন্য অভিবাসীদের ব্যাংকের ওপর আস্থা ফেরাতে উদ্যোগ নেওয়া, নব নির্মিত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর ( টিটিসি) পরিচালনায় সরকার এনজিওদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা, নিরাপদ অভিবাসন সুনিশ্চিত করতে তরুণদের সহযোগীতা নিয়ে অভিবাসন সম্পর্কিত মোবাইল অ্যাপগুলোর প্রয়োগে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা, গন্তব্য দেশে অভিবাসীদের সন্দেহজনক অস্বাভাবিক মৃত্যুর কিছু কিছু কেস পুনরায় ময়না তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া, বায়রাতে যে অভিযোগ সেল গঠন করা হয়েছে তা দ্রুত সক্রিয় করে অভিবাসীদের আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা এবং মানবপাচার সংক্রান্ত মামলাগুলোতে প্রসিকিউশনের হার বাড়ানো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *