বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় ফুটবল উৎসব

ইকরামউজ্জামান

আধুনিক ফুটবলে ‘ফিফা ফ্রেন্ডলি’ ম্যাচের গুরুত্ব এখন প্রয়োজনীয়তা সচেতন মহলের অজানা নয়। ফিফা ‘উইন্ডোতে’ পরিকল্পিতভাবে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশ ম্যাচ খেলে। আর এতে উভয় দেশ চেষ্টা করে ফুটবলের অগ্রগতি এবং উন্নয়ন শতভাগ কাজে লাগাতে। বাংলায় ‘মিত্রভাবাপন্ন’ ম্যাচ বলা হলেও মাঠের লড়াইয়ে কিন্তু কোনো ছাড় নেই।

এর সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে দেশের ভাবমূর্তি। ফুটবলের শক্তি প্রদর্শনী। ফুটবলের গরিমা। ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচের মাধ্যমে উভয় দেশের ফুটবল বিশেষজ্ঞরা পরখ করতে চেষ্টা করেন নিজ নিজ খেলোয়াড়ের দক্ষতা, সামর্থ্য দুর্বলতা এবং সম্ভাবনা। আর এই ‘আউট কাম’ নিয়ে পরবর্তী সময়ে কাজ করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টে অংশ নেওয়ার আগে ফিফা ম্যাচকে প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে দেখা হয়।

ইংল্যান্ডের সকার ম্যাগাজিনের অনলাইন ইস্যুতে গত আগস্টে ফুটবল লেখক জন বেরি লিখেছেন, ‘দুনিয়াজুড়ে দেশে দেশে ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচগুলো সব সময় কিশোর ও তরুণদের ভালো ফুটবল উপভোগের অভিজ্ঞতা দেয়। পাশাপাশি খেলার প্রতি তাদের উৎসাহ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর খেলাটা তো ২২৫ দেশের মাঠে মাঠে গড়ায়।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে অভাবনীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। নতুন সময় আর নতুন পরিস্থিতিতে দেশে আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার জন্ম হয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নতুন ‘গভর্নিং বডি’ কাউন্সিলরদের ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছে। নতুন কমিটি দায়িত্বভারও গ্রহণ করেছে।

মানুষ আর পুরনো দিনে ফিরে যেতে চায় না। তারা ভাবছে বৃহত্তর পরিসরে নতুন বাস্তবতায় সুযোগ এসেছে খেলাটির ক্ষেত্রে বাস্তবধর্মী নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে আবার খেলাটিকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। আর এ জন্য দরকার ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। এটিও সবাই বুঝতে পারছেন, সব জঞ্জাল একসঙ্গে সাফ করা সম্ভব নয়। আর তাই অগ্রাধিকার নির্ণয় করে কাজ করতে হবে। গঠনতন্ত্র, আইন-কানুন পরিবর্তন-পরিবর্ধন-বাতিল এবং নতুন সংযোজন নিয়ে কাজ করলে অনেক সমস্যার সমাধান হতে সময় লাগবে না। অতীতে জেলাগুলোতে নিয়মিতভাবে ফুটবল লিগ এবং টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত না হওয়া সত্ত্বেও কোনো ধরনের কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ হলো ভোটব্যাংকের চিন্তা। জনস্বার্থে এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। মানুষের চিন্তাশক্তি তো বেড়ে গেছে। মানুষ বুঝতে পারে ফুটবল সংস্কৃতি সঠিকভাবে চলছে না।

ঘটনাবহুল সময়ে ঢাকায় দুটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলার জন্য মালদ্বীপ জাতীয় ফুটবল দল এসেছে। তারা ১৩ ও ১৬ নভেম্বর দুটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলবে বসুন্ধরা গ্রুপ কর্তৃক নির্মিত ফিফা এবং এএফসি কর্তৃক অনুমোদিত আধুনিক ‘কিংস অ্যারেনায়’। কোনো করপোরেট হাউস শুধু বাংলাদেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেও ফুটবলের মানোন্নয়নে অগ্রগতি এবং দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে দায়বদ্ধতা থেকে এ ধরনের প্রাইভেট অ্যারেনা ফুটবলপাগল মানুষদের উপহার দেয়নি। বসুন্ধরা গ্রুপের ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের হোম ভেন্যু হলো কিংস অ্যারেনা। বাফুফে দুটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচের আয়োজন করবে কিংস অ্যারেনায়। যদি এই ভেন্যু না থাকত, তাহলে ঢাকায় ম্যাচ আয়োজন সম্ভব হতো না। ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের আধুনিকরণের কাজ শুরু হয়েছে সেই ২০২১ সালের আগস্ট মাসে। প্রথমে বাজেট হয়েছিল ৮৫ কোটি টাকা। এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৮ কোটি টাকায়। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে না। অতএব আসন্ন প্রিমিয়ার লিগে এই ভেন্যু পাওয়া অনিশ্চিত।

মনে আছে, ২০২২ সালের জানুয়ারির এক পড়ন্ত বিকেলে বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসান বলেছিলেন, ‘ইনশা আল্লাহ আমরা আমাদের লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হব। আগামী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রিমিয়ার লিগে কোনো দলের বিপক্ষে হোম ম্যাচ খেলার মাধ্যমে। এটি হবে আমাদের এবং দেশের ফুটবলের জন্য অনেক বড় বিষয়। আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যারেনা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন গ্রুপের ক্রীড়ানুরাগী চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। খেলাধুলার প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত অনুরাগ ও ভালোবাসা এবং দেশের ফুটবলে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে তাঁর এবং পরিবারের সদস্যদের ঐকান্তিকতার জন্যই সম্ভব হয়েছে বিশাল স্পোর্টস কমপ্লেক্সের মধ্যে আধুনিক অ্যারেনা নির্মাণ।’ স্বপ্নবাজ এই ব্যক্তিত্ব, গ্রুপের চেয়ারম্যান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন সবাই মিলে এগিয়ে এলে ফুটবলের জন্য কাজ করলে অবশ্যই সম্ভব হবে দেশের ফুটবলের উত্তরণের পাশাপাশি আবার সুবর্ণময় সময়কে ফিরিয়ে আনা। আবার ফুটবল মাঠে ছুটে আসবে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলা উপভোগের জন্য।

ফুটবল ফেডারেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মধ্যে ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩। খেলাটি গোলশূন্যভাবে শেষ হয়। এর পর থেকে ২০২৪ সালের ৬ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এর মধ্যে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের খেলাও আছে। মালদ্বীপ সর্বশেষ এই মাঠে খেলেছে ২০২৩-এর ১৭ অক্টোবর। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ দল জিতেছিল ২-১ গোলে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ জাতীয় দল মালদ্বীপের বিপক্ষে লড়েছে পাঁচবার। এর মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছে দুবার আর মালদ্বীপ দুবার। আর একটি খেলা ১-১ গোলে ড্র হয়েছে।

একটি সময় ছিল বাংলাদেশ দলের সঙ্গে মালদ্বীপের ফুটবল শক্তির অনেক বেশি পার্থক্য ছিল। ১৯৮৪ সালে প্রথম দক্ষিণ এশীয় ফেডারেশন গেমসে (নেপালের কাঠমাণ্ডুতে) বাংলাদেশ মালদ্বীপকে পরাজিত করেছিল ৫-০ গোলে। এরপর দ্বিতীয় দক্ষিণ এশিয়া ফেডারেশন গেমস ঢাকায় (১৯৮৫ সালে) মালদ্বীপকে পরাজিত করেছে ৪-০ গোলে। ১৯৮৭ সালে কলকাতার গেমসে আবার ৪-০ গোলে। বাংলাদেশ ফুটবল দলের সেই দলগত শক্তি এখন আর নেই। মালদ্বীপ ফুটবলকে পরিকল্পিতভাবে লালন-পালন করে দারুণভাবে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ জাতীয় দল মালদ্বীপের জাতীয় দলের বিপক্ষে এখন খেলায় নামার আগে বিভিন্ন চিন্তা মাথায় আসে। ফিফার র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের তুলনায় মালদ্বীপ এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের ফুটবল এখন দক্ষিণ এশিয়ায় তলানিতে নেমেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বসুন্ধরা কিংসের রাজিব হোসেনের একটি স্ট্যাটাস চোখে পড়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘মালদ্বীপকে আগে ভয় লাগত। শেষ তিনটি ম্যাচ খেলেছি। জিতেছি ও ড্র করেছি। তাই চেষ্টা করব তাদের বিপক্ষে ভালো ফল অব্যাহত রাখতে। এককথায় জিততে। স্প্যানিশ কোচ হ্যাভিয়ের ক্যারবেরা চ্যালেঞ্জ এবং কঠিন সময় পার করছেন। গত সেপ্টেম্বরে ফিফা ফ্রেন্ডলিতে ভুটানের বিপক্ষে বাংলাদেশ একটি ম্যাচ হেরেছে এবং একটিতে জিতেছে। এতে জাতীয় দলের র্যাংকিংয়ে অবনমিত হয়েছে। কথা উঠেছে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স এবং কোচের ভূমিকা নিয়ে। র্যাংকিংয়ে অগ্রগতি নেই। খেলোয়াড়দের মাঠের পারফরম্যান্সে নেই ধারাবাহিকতা। বাফুফের নতুন কমিটি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নিয়েছে। নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের মাটিতে মালদ্বীপের বিপক্ষে দুটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। নতুন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুটি ম্যাচের গুরুত্ব আলাদা। সবাই অপেক্ষা করছেন পুরুষ জাতীয় দলের মাঠের পারফরম্যান্স দেখার জন্য। কোচ বলেছেন দুটি ম্যাচেই জিততে চান। জিততে হলে তো মাঠে খেলেই জিততে হবে। নারী জাতীয় দল পর পর দুবার দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতেছেন। এটি অবশ্যই পুরুষ দলের জন্য অনুপ্রেরণা। বসুন্ধরা কিংসের মাঠে জাতীয় দল লড়বে মালদ্বীপের বিপক্ষে। খুব কাছ থেকে স্বাগতিক দলের খেলোয়াড়রা দর্শকদের সমর্থন পাবেন। যেটা অন্য ভেন্যুতে সম্ভব হয় না। জাতীয় দলে অর্ধেকের বেশি খেলোয়াড় বসুন্ধরা কিংসের। তারা সবাই এই ভেন্যুতে খেলে অভ্যস্ত। এটি অবশ্যই বড় অ্যাডভানটেজ।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক, সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, এআইপিএস এশিয়া, আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন এবং প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights