অপহরণ ওপেন সিক্রেট

কক্সবাজার ও টেকনাফ প্রতিনিধি

রোহিঙ্গার চাপ, ইয়াবাসহ মাদকে সয়লাব হওয়া কক্সবাজারের টেকনাফে নতুন করে দেখা দিয়েছে অপহরণ আতঙ্ক। টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়সংলগ্ন এলাকায় দিন দিন বাড়ছে অপহরণের ঘটনা। অনেকের মতে, এটা এখন ওপেন সিক্রেট। সূত্র জানায়, এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৪৫ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। ৮৮ জন স্থানীয় বাসিন্দা, ৫৬ জন রোহিঙ্গা নাগরিক। ৭৮ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন বলে ভুক্তভোগীদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে। সূত্র মতে, টেকনাফের বাহারছড়া, জাহাজপুরা, লেদা, মুছনি, হ্নীলা, জাদিমুড়া ও হোয়াইক্যং এলাকায় বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় বাসিন্দা হুমায়ুন রশিদ জানান, টার্গেট করে অপহরণ করা হয়। আর্থিকভাবে সচ্ছল বা প্রবাসে আত্মীয়স্বজন রয়েছে- এমন পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে অপহরণ বেড়েছে। প্রথম দিকে অপহরণের শিকার পরিবারগুলো প্রশাসনের চেষ্টায় তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করত। এতে হতাহতের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আনাকে বেশি নিরাপদ মনে করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে ১০-১২ জনকে হত্যা করেছে অপহরণকারীরা।

এদিকে সর্বশেষ টেকনাফে অপহৃত ৯ কৃষককে অপহরণের দুই দিন পর ছেড়ে দিয়েছে অপহরণকারী চক্র। গতকাল সকালে দুই রোহিঙ্গাসহ অপহৃত ৯ জন বাড়ি ফিরেছেন। হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) নুর আহমদ আনোয়ারী অপহৃতদের পরিবারের বরাতে জানিয়েছেন, জনপ্রতি দেড় লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন তারা। তবে পুলিশ বলছে পুলিশের সক্রিয় অভিযানে তারা মুক্ত হয়েছেন। অপহৃতরা হলেন আনোয়ার, গিয়াস, বেলাল, আবু বকর, মুহাম্মদ আলম, কফিল ও নুরুল হোছন। তবে দুই রোহিঙ্গার নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। ওই ইউপি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, গত শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কানজরপাড়ার করাচি পাড়া পাহাড়ি এলাকা থেকে ওই কৃষকদের অপহরণ করা হয়েছিল।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, দুই দিন পুলিশ পাহাড়ে সক্রিয় অভিযান অব্যাহত রাখে। চাপে পড়ে অপহৃতদের ছেড়ে দিয়েছে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা। চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করতে কাজ চলছে।
মানববন্ধন : অপহরণ ও মুক্তিপণ-বাণিজ্য বন্ধের দাবিতে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিব ছড়া এলাকায় গত ২৪ অক্টোবর মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এতে পাহাড়ি গ্রামের বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নেন। তারা সবুজ পাহাড়ে অপহরণ থেকে রক্ষাসহ প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি তোলেন।

প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ : ২৮ এপ্রিল টেকনাফের রাজারছড়া এলাকার কোহিনুর নামের এক তরুণী তিন যুবককে কক্সবাজার থেকে নিজের বাড়িতে ডেকে এনে অপহরণকারী চক্রের হাতে তুলে দেয়। এরপর মুক্তিপণ দাবি করে না পেয়ে হত্যা করে। টেকনাফের পাহাড় থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়।

মুক্তিপণে ফেরা : হ্নীলায় অপহরণের পাঁচ দিন পর মোহাম্মদ আতিক (২২) নামের এক যুবককে ৩০ সেপ্টেম্বর ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। স্বজনদের দাবি, অপহরণকারীরা ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে আতিককে ছেড়েছে। তবে মুক্তিপণ আদায়ের বিষয়টি পুলিশ জানে না বলে জানিয়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই কৃষকসহ পাঁচজন অপহরণের শিকার হন। সবাই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন।

এলাকাবাসীর প্রতিরোধের চেষ্টা : টেকনাফে অপহরণের চেষ্টার সময় দেশীয় তৈরি বন্দুকসহ এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। পরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। আটক জাকির হোসেন (৪৫) টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের হাবিবুর রহমানের ছেলে। ৩০ অক্টোবর বেলা ১১টার দিকে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা মরিচ্যাঘোনাতে এ ঘটনা ঘটে।

জমি হাতিয়ে নিতে অপহরণের কৌশল : টেকনাফের বাহারছড়ার বসতঘর থেকে অপহরণের পর বেলাল উদ্দিন নামে এক যুবককে তিন দিনের মাথায় গত ১৭ অক্টোবর ভোরে উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় অপহৃত যুবকের চাচাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে অস্ত্র ও গুলি। পুলিশের দাবি, জায়গাজমি হাতিয়ে নিতে ভাতিজাকে অপহরণের ষড়যন্ত্র করেন বেলালের চাচা আমির আহমদ। বেলালকে রোহিঙ্গা ডাকাত শফিকে দিয়ে তিনি অপহরণ করান। মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে বেলালের পরিবার জমি বিক্রি করলে তিনি অল্প দামে তা কিনে নেওয়ার ফন্দি আঁটেন। অপহৃত বেলাল উদ্দিন বাহারছড়া ইউনিয়নের শীলখালী এলাকার আলী আহমদের ছেলে ও কক্সবাজার আইনজীবী সমিতি ভবনের নিচতলার ফটোকপির দোকানদার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights