কীটপতঙ্গ, জন্তু-জানোয়ারের আমলনামা!

আপনি যদি রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় একটু মনোযোগ দিয়ে লোকজনের দিকে তাকান তবে অদ্ভুত কিছু দৃশ্য দেখতে পাবেন। আপনি দেখবেন কিছু লোক নির্বিকার, কিছু লোক বিড়বিড় করছে, কেউবা উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছে, অনেকে অশ্লীল ও অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলছে। যাদের চোখ রয়েছে তারাও জবানওয়ালা মানুষের মতো নিজেদের চোখকে নানাভাবে ব্যবহার করছে। তারপর কানওয়ালা মানুষ অর্থাৎ যাদের শ্র্বণশক্তি রয়েছে তারাও আশপাশের শব্দ শোনার জন্য ইতিউতি করছে। পাঁচটি ইন্দ্রিয় দ্বারা মানুষ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে অন্তত পনেরো ধরনের ক্রিয়া-বিক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিচারবিশ্লেষণ করে নিজের শরীর, মন-মস্তিষ্ক ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে চালিত কিংবা পরিচালিত করে। আর এসব কর্ম করতে গিয়ে প্রতিটি মানুষ ভিন্নতর আচরণ করে এই কোলাহলময় পৃথিবীকে নানা রকম বর্ণ বৈচিত্র্য যুদ্ধবিগ্রহ, দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ, প্রেম-ভালোবাসা দৈনন্দিন কাজকর্মে মুখর করে রাখে।

মানবসমাজকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কিংবা মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলে আসছে বহুকাল ধরে। বিজ্ঞানের বহু শাখা-প্রশাখা হয়েছে- গবেষণার স্তর মাটি ভেদ করে ভূগর্ভে চলে গিয়েছে, আবার ভূগর্ভ থেকে মহাকাশ পাহাড় পর্বত হয়ে সমুদ্রের অতলান্তে গবেষণা চলছে কেবল মানুষের প্রয়োজন মনমানসিকতা চিন্তাচেতনাসহ তার রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত আচরণের বৈশিষ্ট্য নিরূপণের জন্য। মানুষকে নিয়ে গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা স্থান-কাল-পাত্র, মাটি-বাতাস-আবহাওয়া, প্রকৃতি ও পরিবেশকে মূল্যায়ন করে থাকে এবং হাজারো উপকরণের মধ্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সবচেয়ে মোক্ষম উপকরণ হলো- কীটপতঙ্গ, পশুপাখি, জন্তু-জানোয়ার। আজকের নিবন্ধে বিষধর কীটপতঙ্গ এবং নির্মম ও নিষ্ঠুর জন্তু-জানোয়ার কীভাবে মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

নিবন্ধের শুরুতেই বলেছি, আপনি দেখবেন কিছু লোক বিড়বিড় করছে। আমরা এখন সেই বিড়বিড়কে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের বাসিন্দাদের আচার-আচরণকে যদি মূল্যায়ন করি তবে দেখতে পাব বেশির ভাগ লোক সীমাহীন অস্থিরতায় ভুগছে। যাদের বয়স চল্লিশের নিচে, তাদের বিরাট একটি অংশ কথায় কথায় অশ্রাব্য গালাগালে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা খুবই কম। কারণ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য যে পরিশ্রম করতে হয় এবং সফলতার জন্য যে পরীক্ষা দিতে হয়, তা তারা করতে রাজি নয়। তাদের চিন্তা-চেতনায় অলীক কল্পনা অপার্থিব প্রাপ্তি কিংবা অলৌকিক প্রাপ্তির গল্পগুজব এমনভাবে বাসা বেঁধেছে যে আপনি তাদের সেই কল্পনাজগৎ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করামাত্রই তারা বুনো মহিষের মতো তেড়ে আসবে এবং আপনার সবকিছু তছনছ করে দেবে।
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মানুষের সাম্প্রতিক অভ্যাস-আচরণ ইত্যাদির কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে আপনি কয়েকটি কীটপতঙ্গ ও পশুপাখির আচরণ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। বাংলার জোঁক, তেলাপোকা ও মাছির বৈশিষ্ট্য যদি বিশ্লেষণ করেন তবে দেখতে পাবেন যে জোঁকেরা অন্য প্রাণীর রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে। মশারাও রক্ত খায় তবে জোঁক আর মশার মধ্যে পার্থক্য হলো, মশা রক্ত খাওয়ার পাশাপাশি জীবাণু ছড়ায় এবং মানুষকে মরণঘাতী ব্যাধিতে আক্রান্ত করে। একইভাবে তেলাপোকা ও মাছির বৈশিষ্ট্য হলো এসব কীটপতঙ্গ যা খায় তার চেয়ে নষ্ট করে বেশি। এসব প্রতঙ্গ পরিবেশ নষ্ট করে এবং জীবাণু ছড়ায়। এগুলোর সবচেয়ে মারাত্মক বৈশিষ্ট্য হলো এরা যেসব খাবার খায় সেসব খাবারের ওপরই মলত্যাগ করে।

প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন যে মশা-মাছি-তেলাপোকা-অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষের দেহ-মনমানসিকতায় এক ধরনের নোংরামি মজ্জাগত অবস্থায় থাকে। উপযুক্ত শিক্ষা, কঠোর পারিবারিক অনুশাসন এবং রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার ও সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে মানুষ সুযোগ পেলেই কীটপতঙ্গের মতো মন্দ আচরণ শুরু করে দেয়। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, দখল-চাঁদাবাজির মতো কর্ম তারা জোঁকের মতো শুরু করে দেয়। জ্বালাও-পোড়াও-ধ্বংস করার মতো প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে লুকানো অবস্থায় থাকে এবং সুযোগ পেলেই তারা তেলাপোকা-মশা-মাছির মতো প্রকৃতি ও পরিবেশকে তছনছ করে দেয়।

গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মানুষের সবচেয়ে বিশ্রী অভ্যাস হলো গালাগাল দেওয়া। মূলত পরশ্রীকাতরতা এবং হীনম্মন্যতা থেকে মানুষ গালাগাল দিয়ে থাকে। হজরত আলী (রা.) বলেছেন, গালাগালি হলো দুর্বলের হাতিয়ার। যারা বাস্তব জীবনে সফল হতে পারে না অথবা সফল হওয়ার জন্য পরিশ্রম চেষ্টা তদবির করতে অনিচ্ছুক তারা সফল মানুষকে দেখলে হিংসায় জ্বলতে থাকে- যাকে প্রমিত বাংলায় বলা হয় পরশ্রীকাতরতা। অর্থাৎ অন্যের শ্রী বা সৌন্দর্য দেখলে যারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তো এই শ্রেণির লোক সব সময়ই দুর্বলচিত্ত, দুর্বল শরীর, দুর্বল চরিত্র এবং আরও বহুবিদ দুর্বলতা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তারা প্রথমে স্বপ্ন দেখে সফল মানুষের সবকিছু তছনছ করে অথবা ভেঙেচুরে চুরমার করে দেওয়ার জন্য। সেহেতু তারা প্রকৃতিগতভাবে দুর্বল তাই তারা সবল-সচ্ছল ও সফলদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে গালাগালকে বেছে নেয়। তারা এই কুকর্মটি করে নিরাপদ দূরত্ব থেকে। অনেকটা সুবে বাংলার বেওয়ারিশ সারমেয়দের মতো। আপনারা সবাই জানেন যে বাংলার সারমেয়রা যেসব কুবস্তু ভক্ষণ করে তা ইউরোপ-আমেরিকার স্বগোত্রীয় পশুকুল করে না। অধিকন্তু এই দেশের ঘেউ ঘেউ শব্দও আপনি উন্নত দেশে শুনতে পাবেন না। এই দেশীয় সারমেয়দের মারামারি ঝগড়াঝাঁটি, লেজ গুটিয়ে পালানো।

যৌনসঙ্গমের বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতা এবং যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগের মতো কুশ্রী অভ্যাস উন্নত জাতের সারমেয় অর্থাৎ জার্মান শিফার্ড অথবা হাউন্ট জাতের সারমেয়দের মধ্যে দেখতে পাবেন না। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের যেসব বাসিন্দার মধ্যে সারমেয় স্বভাব প্রবল তারা লন্ডন আমেরিকায় যুগের পর যুগ বসবাস করার পরও ওসব দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। তারা সুযোগ পেলেই বঙ্গীয় সারমেয়দের মতো ঘেউ ঘেউ করবে এবং সারমেয়জাত স্বভাব দ্বারা প্রকৃতি ও পরিবেশের সর্বোচ্চ সর্বনাশের চেষ্টা চালাবে।

এখন প্রশ্ন হলো, মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলির পরিবর্তে কীটপতঙ্গ ও পশুপাখির স্বভাব কেন প্রবল হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত প্রকৃতির গোলাপ-ময়না-টিয়া-বাঘ-হরিণ এমনকি গরু-ছাগল-মুরগির মতো গৃহপালিত প্রাণীর অভ্যাস মানুষকে কেন প্রভাবিত করে না। কেন তারা ইঁদুর-তেলাপোকা-মশা-মাছি-জোঁক- শেয়াল-কুকুর-হায়েনা দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। আজকের নিবন্ধে উল্লিখিত দুটো প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা আবশ্যক।

পৃথিবীর তাবৎ ধর্মমত-বিজ্ঞান এবং ইতিহাস একমত যে মানুষ সৃষ্টির আগে পশুপাখি, কীটপতঙ্গ তৈরি হয়েছে এবং তারও আগে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, ঝরনাধারা সৃষ্টি হয়েছে। কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর স্থলভাগ সমুদ্রের ওপর ভেসেছে, তারপর দ্বীপ-উপদ্বীপ-দেশ-মহাদেশরূপে কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। ভূপৃষ্ঠের এই বিবর্তন চলমান। প্রকৃতির অমোঘ-ঘুরপাকে একসময় অস্ট্রেলিয়া যেমন ভারতের সঙ্গে ছিল তদ্রুপ ভবিষ্যতে হয়তো আমেরিকা বা আফ্রিকা ভাসতে ভাসতে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে মিলিত হবে।

পৃথিবীর সঙ্গে চন্দ্র ও সূর্যের দূরত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়া এবং জলবায়ু গড়ে ওঠে। আবার জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রথমে উদ্ভিদ তারপর পশুপাশি কীটপতঙ্গ জন্ম নেয় এবং সবার শেষে আসে মানুষ। আদিম ইতিহাসে দুই শ্রেণির মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়। যাদের প্রথমটি হলো- মাটিতে জন্ম নেওয়া জনগোষ্ঠী যাদের বলা হয় Son of Soil আর দ্বিতীয় গোষ্ঠীটি হলো যাযাবর। আমাদের অঞ্চলের ভূমিপুত্রের বৈজ্ঞানিক নাম দ্রাবিড়, যারা কিনা এই অঞ্চলের প্রকৃতি-পরিবেশ, জন্তু-জানোয়ার-কীটপতঙ্গের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেড়ে উঠেছে এবং নিজের অজান্তে নিজেদের মন-মস্তিষ্ক ও শরীর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সব তথ্য ও উপাত্ত সংরক্ষণ করেছে বা করে চলেছে।

মানুষের দেহমনে পশুপাখি-প্রকৃতি ও পরিবেশ কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে তার একটি নিখুঁত চিত্র আমরা পেয়ে যাই অ্যাডগার রাইস বারোজের টারজান দ্য অ্যাপম্যান উপন্যাসে। মানুষকে পশুত্ব রক্ষার জন্য সেই আদিকাল থেকেই মানবিক শিক্ষার বহু সূতিকাগার তৈরি করা হয়েছে যার প্রথমটি হলো মাতৃগর্ভ। তারপর পরিবার বিশেষ করে পিতার ভূমিকা। মানবশিশু যদি মাতৃগর্ভে বসে মানুষের জবান-মানুষের আচরণ- মানুষের খাদ্য এবং মানবিক শব্দ দ্বারা প্রভাবিত হয় তবে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সে শুধু মানুষ খুঁজতে থাকে। পরবর্তী সময়ে ধ্যান-জ্ঞান, পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে মানুষরূপে বেড়ে ওঠা এবং মানুষের মতো আচরণ করতে অভ্যস্ত ও বাধ্য করে। কিন্তু মানবশিশু যখন মাতৃগর্ভে থাকে তখন থেকে শুরু করে তার জীবনের দুই যুগ অর্থাৎ কুড়ি বছর অবধি যদি মানবতার চর্চা- মানবিক শব্দ এবং মানুষ হিসেবে তৈরি হওয়ার বাধ্যবাধকতার মধ্যে না পড়ে তবে নিশ্চিতভাবে সে প্রকৃতির নিকৃষ্ট কীটপতঙ্গ, পশুপাখি দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং আমৃত্যু সুযোগ পেলেই কীটপতঙ্গের মতো ছটছট করবে এবং জন্তু-জানোয়ারের মতো আচরণ ও কর্মকাণ্ড করবে।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার নিবন্ধের ইতি টানার আগে উপসংহার নিয়ে কিছু বলতে চাই। ২০২৪ সালের বাংলাদেশে যেসব মানুষরূপী পাশবিক মানুষের কথাবার্তা আচার-আচরণ এবং কর্মকাণ্ড দ্বারা আপনি আহত হচ্ছেন তাদের বিষয়ে উল্লিখিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যদি খোঁজখবর নেন তবে দেখতে পাবেন যে পাশবিক মনুষ্যরূপী প্রাণীগুলো সেই মাতৃজঠর থেকেই বিরূপ পরিস্থিতিতে কীটপতঙ্গ ও জন্তু-জানোয়ারের প্রভাবযুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। ফলে তাদের পশুত্ব সহজাত এবং তাদের আচরণ অতি স্বাভাবিক। রাস্তার ঘেউ ঘেউ প্রাণী দ্বারা আপনি যেমন মনোবেদনায় আক্রান্ত হন না অথবা তেলাপোকা, মশা-মাছির আক্রমণে যেমন আপনি হাউমাউ করে কাঁদেন না তদ্রুপ পাশবিক বৈশিষ্ট্যের মানুষরূপীদের কথা, আচরণ, কর্ম দ্বারা আহত না হওয়াই প্রমাণ করে যে আপনি মানুষ।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights