গণতন্ত্র : জনগণকে আবেগহীন হতে হবে

ক্ষমতা অর্পণ করার পর ক্ষমতা প্রদানকারীর নৈতিক দায়িত্ব রয়ে যায় ক্ষমতা গ্রহণকারীর গতিবিধির ওপর। এটাই নিয়ম। জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা প্রদান করার পর হাত-পা ঝেড়ে যারা বসে থাকে তাদের দুর্ভোগ খণ্ডানো যায় না। আর সে কারণেই আমরা গণতন্ত্র-প্রত্যাশী এই দেশের জনগণ জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের কার্যকলাপ দেখে হায় হায়, গেল গেল রব করি। নির্বাচন এলে একটা আবেগে গা ভাসিয়ে দিই। সেই আবেগ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, আমাদের নির্বাচিত প্রার্থীর ওজন দশাসই হলেও কাঁধে চড়াতে কোমরে জোর পাই না বলতেও পারি না। আসলে আবেগপ্রবণ জনগণ গণতন্ত্র বলতে বুঝে আবেগতন্ত্র। এখন প্রশ্ন হলো, নির্বাচন এলে এই আবেগ আসে কোথা থেকে? নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, যে কোনো রাজনৈতিক সভাসমাবেশে দলের কিছু লোক থাকে। সেসব লোকের কাজই হলো দলকে আবেগমথিত করে জনগণের উদ্দেশে ছাড়া।

এই আবেগে মথিত হওয়া এক ধরনের গণসংক্রামিত রোগ। বক্তা যখনই এমন কোনো বিশেষ বাক্যবাণ ছুড়লেন সঙ্গে সঙ্গে সেসব লোকের কাজ হলো করতালি দেওয়া। আর করতালির এমনই এক শক্তি যে, এক্ষুনি অন্যকে প্রভাবিত করে, আবেগকে প্রশ্রয় দেয়। শ্রোতা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। আসলে প্রথম করতালির স্রষ্টা তার কৌশল কাজে লাগিয়ে নেন। বিষয়টি পুরো মনস্তাত্ত্বিক। সে কারণেই গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের মনোজগৎ যদি উন্নত না হয় তাহলে যে কোনো কৌশলই বাজিমাত করে ফেলে। গণতন্ত্রে জনগণকে হতে হবে আবেগহীন। মনে রাখতে হবে, এই তন্ত্রে সুযোগসুবিধা প্রচুর, এই বিশ্বাসে মানুষ তার আত্মকেন্দ্রিকতাকে কাজে লাগিয়ে নেয়। আর সুযোগসন্ধানীরা এটাও ভালো জানে, উচ্ছিষ্ট খাদ্য ছড়ালে কাকের দল ভিড় করবে। কা কা করে জায়গা গরম করবে। কারণ নীরবতা তাদের একদম অপছন্দ। নীরবতা মানেই গণতন্ত্রের জাগরণ। অর্থাৎ জনগণের মনোজগতের উত্থান তা তারা টের পেয়ে যায়।

লক্ষ করে দেখবেন যে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধির ঘরেবাইরে পা রাখার জায়গা নেই। এত গমগমি ভাব। যদি কেউ তাদের দরজায় পা না রাখত, অসীম নীরবতা বিরাজ করত। তারা ভীত হতেন। কেন এমন হলো? তাহলে উচ্ছিষ্ট খেতে কি কেউ রাজি নয়? এ তো সভ্যতার লক্ষণ।
মনে রাখা দরকার আমরা মঙ্গলময় সুন্দর সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে প্রত্যাশী। কিন্তু তা এত সহজ ব্যাপার নয়। যদি তা করতে হয় তাহলে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের অবশ্যই বুদ্ধিকে গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে সহানুভূতিকে গড়াতে হবে। এটা গড়ে তুলব বললেই গড়া যায় না। মানুষের বুদ্ধি ও সহানুভূতিকে গড়ার একটা সময় থাকে। সেই সময়ই অর্থাৎ শিশু অবস্থা থেকে যদি বিষয়গুলোকে শিক্ষার মাধ্যম করে নেওয়া যায় তাহলেই সম্ভব। অনেকেই মনে করেন, রাষ্ট্রের আইনব্যবস্থা যদি কঠোর হয় এবং যথাযথ কার্যকরী হয় তাহলে নাগরিকরা সুস্থ জীবনের অধিকারী হয়। গণতন্ত্র রক্ষা করা যায়। রাষ্ট্র নাগরিকের মঙ্গলময় জীবন দিতে পারে। ভালো কথা। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও মনে রাখা দরকার, আইনব্যবস্থা কোনো সরকারি মেশিন নয় যে বোতাম টিপলেই চলতে থাকবে। রাজতন্ত্রের সঙ্গে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিমণ্ডলীর আইনসভার আইনের পরিচালনা বিষয়ে পার্থক্য আছে। রাজার আইনে প্রজার সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন সম্পর্কে প্রতিটি নাগরিকের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আইনজীবী ছাড়া সেসব আইনের নিয়মকানুন, ধারা কজন জানেন। তা ছাড়া বিচারব্যবস্থা এ দেশে এত দীর্ঘ প্রক্রিয়া যে সহজে কোনো বিষয়েরই নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সে কারণেই আইন লঙ্ঘন সম্ভব হচ্ছে। মরণশীল মানুষের চেয়ে কোনো অপরাধীর ওপর আরোপিত আইনের বিচার চলাকালীন ব্যবস্থার গড় আয়ু অনেক বেশি। সুতরাং অপরাধ দমনে আইন তাড়াতাড়ি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। আবার শাসক গোষ্ঠী দ্বারা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার খবরও শোনা যায়।

আশা করা হয়েছিল গণতান্ত্রিক নতুন পথ, রাজতন্ত্রের পুরনো পথ থেকে অনেক ভালো হবে। আশা অমূলক ছিল না। কিন্তু আবার এই পথ যে খুব সহজে খারাপও হয়ে যেতে পারে, সে ধারণাও মিথ্যা নয়। কারণ শাসনব্যবস্থার খবরদারি করার ভার বেতনভুক কর্মচারীদের হাতে দিয়ে রাখা আছে। আবার এই দেশের কিছু নাগরিককে জনগণের হয়ে কর্তব্য পালন করার জন্য নির্বাচিত করা হয়। তারাই সরকারি ব্যবস্থার দিকে নজর রাখেন। সরকারি কর্মপদ্ধতি ঠিক করেন। আশা করা হয় তারা সাধারণ মানুষ থেকে এগিয়ে। বিষয়ে নিপুণ, কর্মে দক্ষ, মেধাবী অনেক কিছু। আশা করা হয় তারা সুন্দর, তাই গণতন্ত্র সুন্দর হবে। সাধারণ মানুষও সুন্দর হবে। কিন্তু তা কি হয়? আমরা বা সাধারণ মানুষ জনগণের ভোটে নির্বাচিতদের কাছ থেকে যা আশা করে তা কি পাওয়া যায়? বহুলাংশেই তা পাওয়া যায় না।

বলতে হয় জগতে অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে যে নব্য জ্ঞানের শুরু হয়েছে, এতে বর্তমান যুগ জটিল হচ্ছে। অনেক মানুষ মনে করে এ জগৎটা কাঁচামালের মতো। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ভোগ করে নিতে হবে। তবে এটা ঠিক, কোনো সভ্য সমাজে যদি বেশির ভাগ মানুষ চুরি করে তাহলে তাদের ধরা হবে এবং যদি ধরা না হয় তাহলে আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন-এই মনস্তাত্ত্বিক দিক লক্ষ্য করে আবার অনেকেই চৌর্যবৃত্তি নেয়। এতে তাদের সুবিধা হয়। কারণ প্রত্যেকেই যদি চুরি করে তাহলে চৌর্যবৃত্তির বড় অসুবিধা। অবশ্য বলতে হয় মানুষের সততা এখনো আছে এই বিশ্বাসে যে, আল্লাহ আছেন-যিনি আইন বা পুলিশ ব্যর্থ হলে চৌর্যবৃত্তির শাস্তি দেবেন। মানুষের এই সততা চৌর্যবৃত্তির স্বর্গীয় সমর্থন তত অনিশ্চিত করবে। তারা মনে করবে নরক আগের মতো আর তত ভয়ংকর নয়। যা-ই হোক, আমরা গণতন্ত্র প্রত্যাশী সব মানুষই চাই যাতে কেউ চুরি না করে। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৃষ্টি থাকা দরকার কেউ চুরি করছে কি না সেদিকে। নিজের সুবিধা এবং অন্যের সুবিধা-এ দুটি দিকই আমাদের দেখতে হবে। এটাই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। সে কারণেই বলা হয় জনতার আদালত।

♦ লেখক : প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights