চীন সফর হবে বহুমাত্রিক

জুলকার নাইন ও মানিক মুনতাসির

তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আগামীকাল চীনের রাজধানী বেইজিং যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ভূরাজনীতি, রোহিঙ্গা সংকট ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের সফরকে ‘বহুমাত্রিক’ হিসেবে দেখছেন কূটনীতিকরা। দুই দেশের মধ্যে এবারের সফরে কমপক্ষে ১৪টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতিও নিয়েছে দুই দেশ। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পে চীনের ঋণের ঘোষণা আসতে পারে। পাশাপাশি এ সফরে বেইজিংয়ে একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করবে বাংলাদেশ। এ সম্মেলন থেকে ৭০০ কোটি ডলারের তহবিল সংগ্রহের টার্গেট নেওয়া হয়েছে। সফরসূচি অনুসারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল সোমবার বেইজিং পৌঁছাবেন। মঙ্গলবার চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হবে। বৈঠক শেষে স্বাক্ষর হবে চুক্তি ও সমঝোতা। পরদিন বুধবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন চীনের পার্লামেন্ট ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস অব চায়নার প্রেসিডেন্ট ঝাও লেজির সঙ্গেও বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, চীন আমাদের বড় উন্নয়ন অংশীদার। উন্নয়ন অভিযাত্রা যেন বেগবান হয়, সফরে এটাই প্রাধান্য পাবে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফর হবে আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। প্রধানমন্ত্রীর এ সফর হবে গেম চেঞ্জার।

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কৃষি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিক্ষা, রোহিঙ্গা সংকট, রিজার্ভ সহায়তা প্রভৃতি বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। সফরে বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট ঘাটতি পূরণের জণ্য ঋণসুবিধা নিয়ে আলোচনা হবে। সড়ক, সেতু ও রেলের আরও বেশকটি প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনকে পাশে চাইবে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে সড়ক ও রেল মন্ত্রণালয়ের নয়টি প্রকল্পে অর্থায়ন প্রস্তাব প্রস্তুত হয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর রেলসংযোগের সঙ্গে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর, কুয়াকাটা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের প্রকল্প ও মেট্রোরেলের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের অর্থায়ন প্রসঙ্গ আছে। চীন সফরে মহেশখালী থেকে একটি গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সাতটি প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাব দেওয়া হবে। এর মধ্যে মহেশখালীর গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্পটি জিটুজিতে করার প্রস্তাব দেওয়া হবে।
জানা গেছে, মোংলা বন্দর আধুনিকায়ন, আঞ্চলিক বাণিজ্য, যোগাযোগসহ এ বন্দরের সুবিধাদি বৃদ্ধি ও নানা কার্যক্রমের প্রসঙ্গ থাকছে আলোচ্য সূচিতে। পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় চীনের বিনিয়োগের আকর্ষণ করতে চায় সরকার। ইতোমধ্যে চীন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা পায়রা, মোংলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শনও করেছেন। সূত্র আরও জানান, মিয়ানমারের সঙ্গে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে চীনের সহায়তা চাওয়া হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজা হতে পারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। একই সঙ্গে যে কোনো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে ব্রিকসে (বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট) যুক্ত করতে চীনের সহায়তা চাওয়া হবে। ব্রিকসে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি সদস্যদেশ বা অংশীদার রাষ্ট্র যেভাবেই হোক, সেটা নিয়ে তাদের সমর্থন চাওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন চাইলে বাংলাদেশের এ জোটে যুক্ত অত্যন্ত সহজ হবে। কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর সামনে রেখে ইতোমধ্যে বার্তা দিয়েছে বেইজিং। চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক রাজনৈতিক বিশ্বাস আরও গভীর করতে চায় দেশটি। একই সঙ্গে দুই দেশের উন্নয়ন কৌশলগুলো আরও একত্র, বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার উচ্চ অগ্রগতি, বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে গতি বাড়ানো, বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একটি নতুন স্তরে উন্নীত করতে চায় বেইজিং।

এর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালে ঢাকা সফরের সময় ২৭টি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। এতে সরকারের সঙ্গে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো অনুদান, ঋণ ও প্রাইভেট সেক্টরে আরও কিছু সমঝোতার আওতায় সব মিলিয়ে ৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছিল। পরে ২০১৯ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে গিয়েছিলেন। পাঁচ বছর পর আবারও চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।

আয়োজন হবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে বেইজিংয়ে একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করবে বাংলাদেশ। চীনের বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে এ বাণিজ্য সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন তিনি। এতে দুই দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা কমানোর উপায় খুঁজে বের করা হবে। চীন ও বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ১ হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগসুবিধা নিয়ে আলোচনার জন্য বিভিন্ন ব্যবসায়িক অধিবেশনে যোগ দেবেন। অর্থ, বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই) ও বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস যৌথভাবে এ বাণিজ্য সামিটের আয়োজন করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights