ছয় কমিশন এবং জাতির প্রত্যাশা

আমাদের ছাত্রাবস্থায় আমরা পড়েছি ‘কুজনেটস হাইপোথিসিস’ বা কুজনেটের উপপ্রমেয় নামে খুব আকর্ষণীয় এক বুর্জোয়া কৌশল। এই ধারণার প্রবর্তক ছিলেন সাইমন কুজনেটস নামের ১৯৭১ সালে নোবেলজয়ী এক অর্থনীতিবিদ। ধারণাটির অন্তর্নিহিত বক্তব্য হচ্ছে এই যে উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক স্তরে আয়বৈষম্য নিয়ে মাথাব্যথার কারণ নেই; প্রাথমিক স্তরে বৈষম্য বাড়বে বৈ কমবে না এবং তা কেন, সে এক লম্বা ফিরিস্তি। কিন্তু প্রবৃদ্ধি শিখরে পৌঁছানোর পর আয়বৈষম্য হবে নিম্নগামী।

একে বলে ‘ইনভারটেড ইউ হাইপোথিসিস’। সুতরাং নীতিগত সুপারিশ হচ্ছে বৈষম্য বাড়ছে তো বাড়ুক, ঘাবড়াও মাত, আখেরে সমতা সমর্পিত হবে। অর্থাৎ আগে কেকটিকে বড় করতে দাও, তারপর বিতরণের কথা করোটিতে রাখো। খাবলা দিয়ে এখনই খেতে চাইলে সবাই না খেয়ে মরতে হবে; তার চেয়ে বরং কিছু লোক ধনী হয়ে বিনিয়োগ করুক, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হোক, তখন উপচে পড়া প্রভাবে সবাই কিছু না কিছু অংশ পাবে, ‘জিডিপি দ্রুত বাড়ছে, এখন অসাম্যও বাড়বে, এটিই স্বাভাবিক, এমনকি প্রয়োজনীয়ও, ওপর তলার মানুষের আয় বেশি বাড়লে সঞ্চয় বাড়বে, লগ্নি বাড়বে’।

বলা বাহুল্য, এই তত্ত্বের ওপর সওয়ার অনেক দেশ কৌশল প্রণয়ন করেছে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ তত্ত্বটির অসারতা প্রমাণে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে কেউ যদি খাড়া করায়, তখন তাকে দোষ দেওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
দুই.

তবে সমালোচকরা আয়বৃদ্ধির জন্য অসাম্য দরকার এমনতর চিন্তার পেছনে কোনো সাবলীল অর্থনৈতিক যুক্তি খুঁজে পাননি এবং বিভিন্ন দেশের বাস্তব অভিজ্ঞতায়ও এমন কোনো ধারণা ধোপে টেকে বলে মনে হয় না। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই ধরনের মনোভাবের প্রবল বিরোধী।

তিনি মনে করেন, বরং উল্টো রথে অনেক দেশেই আয় খুব দ্রুত বেড়েছে আবার একই সঙ্গে অসাম্যও কমেছে। উদাহরণস্বরূপ, সেন বলছেন, জাপানে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যখন মেজি রেস্টোরেশন হলো, দ্রুত আয়বৃদ্ধি শুরু হলো, শাসকরা ঠিক করলেন সবাইকে খুব তাড়াতাড়ি সাক্ষর করে তুলবেন, ৪০ বছরের মধ্যে তা করেও দেওয়া হলো, স্বাস্থ্য পরিষেবাও প্রসারিত হলো এবং আয়ের অসাম্যও তখন বাড়েনি। দক্ষিণ কোরিয়ায় গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে প্রচণ্ড রকম গ্রোথ হলো, কিন্তু অসাম্যও কমল। মোটকথা, অসাম্য ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না এমন ধারণা অবান্তর, অগ্রহণযোগ্য বলে দাবি এই অর্থনীতিবিদের।

সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকে ভাবেন গণতন্ত্র ও দ্রুত প্রবৃদ্ধি একসঙ্গে যায় না—এদের সম্পর্ক নাকি শাপে-নেউলে।

আসলে এটি ভ্রান্ত ধারণা। কারণ প্রথমত, এই দুই সহগের মধ্যে কার্যকারণ অনুপস্থিত এবং দ্বিতীয়ত, যেমন ভারতে, যতটুকু প্রবৃদ্ধি এসেছে, তা গণতন্ত্রের জামানায় বললে বোধ করি ভুল হবে না।

এই নিবন্ধে অমর্ত্য সেনের ক্ষুরধার যুক্তি ক্ষেত্রবিশেষ হুবহু তুলে ধরা হবে। তিনি বলছেন, ‘আয়বৃদ্ধির জন্য অসাম্য চাই—এই কুযুক্তিটাও একেবারে ওই গোত্রেরই। এর পরে যখন দেখা যাবে অসাম্যটাও কমানো যাচ্ছে, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তার প্রসার ঘটছে, আয়ের অসাম্যও কমছে এবং গ্রোথও হচ্ছে, তখন লোকে আর এই নিয়ে বলবে না। তখন হয়তো আবার একটা অন্য কিছু খাড়া করবে…চীনে এত দ্রুত আয়বৃদ্ধি হতে পারত না, যদি সেখানকার মানুষ প্রাথমিক সক্ষমতাগুলো অনেকখানি অর্জন করতে না পারত। আমাদের দেশের সরকারি বিশ্বাস হচ্ছে যে অপুষ্ট, রুগ্ণ এবং অশিক্ষিত শ্রমিকরা একটা শিল্প বিপ্লব নিয়ে আসবে।’ প্রসঙ্গত বলা দরকার যে গেল পাঁচ দশকেও বাংলাদেশ জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানসম্মত করতে পারেনি।

তিন.

এক সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য যা বলছেন, তা বাংলাদেশের জন্যও সত্যি, “মেক ইন ইন্ডিয়া তখনই সম্ভব, যখন আমাদের ‘মেক’ করার ক্ষমতা আছে। আমাদের দেশে বিশ্ববাজারে রপ্তানি করতে পারি এমন প্রধানত তিনটা জিনিস তৈরি করা হয়। একটা হচ্ছে ফার্মাসিউটিক্যালস, মানে ওষুধপত্র। সেটা তো অত্যন্ত দক্ষ কর্মীরা তৈরি করেন, মানে যাঁরা আমাদের দেশের ‘ফার্স্ট বয়’ এবং ‘ফার্স্ট গার্ল’ও। তার পরে হচ্ছে তথ্য-প্রযুক্তি, আইটি, সেটাও তাঁদেরই ব্যাপার। তৃতীয় হচ্ছে অটো পার্টস, মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ, সেটা যান্ত্রিকভাবে আমরা ভালো করতে পারি। জাপান বা চীন এ রকম হাজারটা জিনিস তৈরি করতে পারে, কারণ সেখানে কর্মীরা শিক্ষিত, তাই তাঁদের যদি বলা হয় একটা জিনিস এই ভাবে করতে হবে, এই ভাবে তার গুণগত মান বজায় রাখতে হবে, তাঁরা সেটা করতে পারবেন। মৌলিক একটা শিক্ষা না থাকলে সেটা সম্ভবই নয়। ফলে আমরা যেখানে তিনটা জিনিসে দক্ষতা দেখাই, চীনারা সেখানে প্রায় চার হাজার জিনিসে দক্ষ। পার্থক্যটা খুঁজতে গেলে দেখা যাবে তার পেছনে আছে আমাদের শিক্ষার অভাব এবং অসাম্য, স্বাস্থ্যের অভাব এবং অসাম্য। সুতরাং দ্রুত আয়বৃদ্ধির জন্য অসাম্য দরকার—এই ধারণার পক্ষে শুধু যে যুক্তি ও তথ্যের অভাব আছে তা-ই নয়, এর বিপক্ষের যুক্তিগুলো অত্যন্ত জোরালো। কিন্তু এই সম্পূর্ণ ভুল ধারণাটা চালু হয়েছে, কারণ এটা চালু করা হয়েছে।”

চার.

বাংলাদেশে চলমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ব্যবহৃত ‘সংস্কার’ বা ‘খোলনলচে বদলে দেওয়া’ কথাগুলো বিভিন্ন উপায়ে অমর্ত্য সেনের চিন্তায় ছিল : “সমাজের মধ্যে একটা খুব পাকা রকম ব্যবধান, ‘আমরা-ওরা’র একটা পার্থক্য, খুব বড় রকমেরই হয়েছে…আমাদের মতো লোকেরা যদি কোনো আইন ভাঙে, মনে হয় হয়তো পুলিশ গ্রেপ্তার করবে, তাহলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে কোনো বড় আইনজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করি, কোনো ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট গোছের কারো সঙ্গে চেনা থাকলে তাঁকে বলি, আমাদের কাছে সেটা একটা বড় সমস্যা নয়। কিন্তু বহু মানুষের কাছে এটা একটা ভীষণ সমস্যা, পুলিশের হাজতে গেলে বের করার কোনো উপায়ই নেই। তাঁদের সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তা যথেষ্ট করা হয়েছে বলে মনে হয় না।”

অমর্ত্য সেন মনে করেন, এই ব্যবধানটিই বোধ হয় গণতন্ত্রের পক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। গণতন্ত্র দিয়ে যা হতে পারত, তা হচ্ছে না। তিনি লিখেছেন, “সাধারণ লোকের নাম করে যাঁরা অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা আদায় করছেন, তাঁরা তো খুব সাধারণ না। সত্যিকারের সাধারণ মানুষের প্রতি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে যে কত অবহেলা হচ্ছে, সেগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যেমন অনেকেরই ধারণা ছিল, ওই এলপিজির ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য। কিন্তু সাধারণ লোকের তো এলপিজি ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। মনে আছে, ১৯৫২-৫৩ সালে আমার বন্ধু ও সহযোগী মৃণাল দত্তচৌধুরী ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের তথ্য সংগ্রহের কাজ পেয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম প্রশ্নোত্তর শুনতে। খুব দুস্থ মানুষের বসতি ছিল সেটা, বোধ হয় কলুটোলা অঞ্চলে। সেখানে এনএসএসের নিয়ম অনুসারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনাদের বাড়িতে কি রেফ্রিজারেটর আছে?’ ‘এয়ারকন্ডিশনার আছে?’ আমার যে জবাবটা সবচেয়ে মনে আছে—একটা পরিবারের কর্তা এয়ারকন্ডিশনার শব্দটা শোনেননি, তিনি প্রশ্ন শুনে বললেন, ‘আমি ঠিক জানি না আমাদের ঘরে আছে কি না, আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে হবে!’”

পাঁচ.

বর্তমানে যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলছে, সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে এবং ছয়টি কমিশন করা হয়েছে, তার মূলে কিন্তু বৈষম্য—প্রবৃদ্ধির মধ্যকার ইতিবাচক সম্পর্ক সম্বন্ধনীয় কৌশল ও নীতিমালা। কুজনেটস হাইপোথিসিস আমাদের জন্য কাল হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক খাতে প্রাপ্য গুরুত্ব না দিয়ে কেবলই প্রবৃদ্ধিতাড়িত উন্নয়ন কৌশল বুমেরাং হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষত সত্তরের দশকের শেষ থেকে এযাবৎকালের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে মূল দর্শন ছিল ‘আগে কেক বড় হোক, পড়ে বিতরণ’ ভাবনা। সেই কেক বড় করতে গিয়ে ঋণখেলাপি, দুর্নীতি, গণতন্ত্রহীনতা, অপশাসন জেঁকে বসেছিল। বর্তমান আয় ও সম্পদ বৈষম্য, ধর্মীয় বিভাজন, সামাজিক অবক্ষয় প্রমাণ করে যে সবাইকে সমান সুযোগ দিয়ে অর্থাৎ অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ঘটাতে পারলে হয়তো বাংলাদেশের অগ্রগতির গল্পটি অন্য রকম হতে পারত, উন্নয়ন টেকসই করা যেত। আমাদের আশপাশের অবস্থাও যে খুব ভালো, তা হলফ করে বলা যাবে না। তবে কারণ একই—আয়বৈষম্য প্রবৃদ্ধির প্রধান নিয়ামক।

ছয়.

সুতরাং ‘খোলনলচে’ বদলে দেওয়ার জন্য গঠিত ছয় কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে একটি সমতামুখী উন্নয়ন কৌশলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস। সেখানে ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না’ বরং সবাই কমবেশি খেতে পারবে, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নয়, সবাই বাংলাদেশি হবে, রাষ্ট্রযন্ত্র নিপীড়িতের পক্ষে থাকবে, নারী-পুরুষ, ভদ্রলোক-ছোটলোক ভেদাভেদ চিরবিদায় নেবে।

পাদটীকা

এক ফরাসি ভদ্রলোক বাংলা শিখেছেন, তিনি এক বাঙালি বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছেন, বাংলায় যে ‘বইটই’ বলা হয়, ওই টইটা কোথা থেকে এলো। বন্ধুটি উত্তর দিয়েছিলেন, এটি কিন্তু ভদ্রলোকেরা বলে না, ছোটলোক-টোটলোকেরাই বলে!

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights