বছর শেষে কমবে মূল্যস্ফীতি
নিজস্ব প্রতিবেদক
চলতি বছরের শেষে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে আসবে বলে প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আরও ছয় মাস সময় চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ওপর যাতে কোনো চাপ না পড়ে সেজন্য বাজেটের আকার কমিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের এ সংকোচন নীতি চলমান থাকবে। গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রস্তাবিত বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ প্রত্যাশার এ কথা জানান। এ ছাড়া বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেবে। এটা খুবই স্বাভাবিক নিয়ম বলে মনে করেন তিনি।
ব্যাংক খাতে তীব্র তারল্য সংকট সত্ত্বেও বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে, এতে ব্যাংকে তারল্য সংকট আরও বাড়বে কি না-বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া এটা সব বাজেটেই সব অর্থমন্ত্রীই করে থাকেন। সব সরকার ঋণ করে দেশ চালিয়ে থাকেন। উন্নত দেশগুলো আরও অনেক বেশি ঋণ নিয়ে থাকে, আমরা তো এটা জিডিপির মাত্র ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রেখেছি। কাজেই এটা এত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ঘরে রয়েছে। বৈশ্বিক কারণে মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ায় টাকার মান কমেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ার জন্য এটা কারণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার নিয়েছি। আরও যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন নেব। যদিও গত ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশে রাখা সম্ভব হয়েছে। বৃহস্পতিবার উপস্থাপিত বাজেট বক্তৃতায় মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতির আওতায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা উল্লেখ করেছি। কভিড-১৯ মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখনো আমাদের দেশে ৯ শতাংশের ঘরে রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তাদের দেশে সুদের হার বাড়াতে থাকলে আমাদের দেশে ক্যাপিটাল ফ্লো কমে যেতে থাকে। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণও অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে আমাদের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি তৈরি হয়। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়তে থাকে এবং এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার উল্লেখযোগ্য ডেপ্রিসিয়েশন ঘটে। আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ার এটা একটা প্রধান কারণ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দুই বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা ক্ষমতায় আসার পর মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে থাকলেও আমরা কিন্তু তা দুই বছরের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে এনেছিলাম। এবারও আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি, তার ফলে আগামীতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, এটা আমি আপনাদেরকে দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই।’ তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ওএমএস এবং ফ্যামিলি কার্ডসহ যেসব কার্যক্রম চলছে তা চলমান থাকবে এবং প্রয়োজনে এগুলোর পরিসর আরও বাড়াবার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ২০২৫ সালের পর সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যুক্ত হতে হবে। পেনশন সুবিধা পান এমন সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা হবে। এরই মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের এ ব্যবস্থার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের আগামী ২০২৫ সালের জুলাই থেকে এ ব্যবস্থার আওতাভুক্ত করা হবে। মন্ত্রী আরও বলেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার তহবিল পরিচালনার ব্যয় সরকার বহন করায় এবং বিনিয়োগ মুনাফা জমাকারীদের মধ্যে বিভাজন হওয়ায় এটি হবে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় পেনশন স্কিম।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। আগের মতোই রাখা হয়েছে কেন? এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমি বাজেট বক্তব্যে বলেছি। আপনারাই বলছেন, আমাদের কর জিডিপি রেশিও অনেক কম। আবার কর বসালেও সেটার সমালোচনা করছেন। তাহলে আমরা কোথায় যাব? বাজেটের আকার কমানো হয়েছে। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান অনেক কমেছে। এতে গত কয়েক বছরে মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে গেছে- এটা কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। এটা অপরিপক্ব প্রশ্ন। অর্থনীতির আকার ছোট হচ্ছে না। এটা বাড়ছে। আমরা বরং বাজেটকে শুধু সাময়িকভাবে সংকুচিত করেছি। এটা একটা কৌশল। পরে একই বিষয়ে বিস্তারিত যুক্তি তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী।
সংবাদ সম্মেলনে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, পরিকল্পনা মন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালাম, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুস শহীদ, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে অর্থমন্ত্রীকে তাঁরা সবাই সহায়তা করেন। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার।
প্রসঙ্গ এনবিআরের লোকবল বৃদ্ধি : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জনবল বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, জনবল নিয়োগের বিষয়ে এনবিআর থেকে চিঠি এসেছিল। আমরা জনবল বৃদ্ধি করেছি। আশা করছি, সামনে আরও বৃদ্ধি করা হবে। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অটোমেশনের বিষয়টি শুরু হয়েছে। অর্থবিভাগ থেকে আমরা জনবল নিয়োগের বিষয়ে অনুমোদন পেয়েছি। ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হলেও ব্যাংক খাতে এর প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার। ব্যাংকের তারল্যের সঙ্গে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রসঙ্গ কালো টাকা : কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, অডিটজনিত কারণে কিছু ব্যবসায়ী তাদের বৈধ সম্পদ রিটার্ন দাখিলের সময় দেখাতে পারছেন না, সে কারণে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ী মহলের পক্ষ থেকে একটা দাবি এসেছিল, সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে একটা দাবি এসেছিল, সে কারণেই আমরা এই সুযোগটা দিয়েছি।
গভর্নরকে বর্জন : সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী প্রারম্ভিক বক্তব্যের পর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েতউল্লাহ মীরধা বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কথা বলেন। এ সময় গভর্নরকে কোনোরকম কথা না বলতে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে মীরধা বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। সে জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা কেউ তাঁর বক্তব্য শুনব না। তিনি যেন কোনো বক্তব্য না দেন, সে বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বক্তব্য দিলে আমরা তা বয়কট করব। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গভর্নরকে কোনো কথা বলতে দেননি অর্থমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনের বেশির ভাগ সময় গভর্নরকে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায়।
প্রসঙ্গ ব্যাংক সংস্কার কমিশন : সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, কোনো ব্যাংক বন্ধ করে সংস্কার করা হবে না। প্রতিটা ব্যাংক চালু রেখেই ব্যাংকগুলো সংস্কার করা হবে। এর আগে ব্যাংক সংস্কার কমিশনের কথা বলা হলেও তা করা হয়নি। এবারের বাজেটে সে প্রসঙ্গে কিছু বলাও হয়নি, আবার খেলাপি ঋণও ২ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি চলে গেছে- এ বিষয়ে বাজেটে কোনো নির্দেশনা নেই কেন? এমন প্রশ্নের জবাব দিতে অর্থমন্ত্রী উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে আহ্বান তিনি জানান। তখন তিনি বলেন, ব্যাংকে মানুষ টাকা জমা রাখছে। ব্যাংক সে জন্য সুদ দেয়। ব্যাংক যদি সেই টাকাটা কোথাও বিনিয়োগ করতে না পারে, তাহলে ব্যাংক তো বন্ধ হবে। ব্যাংক বন্ধ করা কোনো সরকারের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যাংকের পারফরমেন্স ও নন-পারফরমেন্স লোনের অঙ্কটা এক দিনের নয় এবং এগুলো বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। মূলত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখা এবং ব্যাংকের সুস্থ পরিচালনা করা; এই দুটির ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। তিনি উল্লেখ করেন, সরকার এ বিষয়ে সচেতন।