বিএনপিতে শুদ্ধি অভিযান

শফিউল আলম দোলন

বিএনপিতে শুদ্ধি অভিযান শুরু হচ্ছে। এ অভিযানে ছিটকে পড়তে পারেন বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতা। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিসহ গঠনতন্ত্র অনুমোদিত অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে সাম্প্রতিক আন্দোলনে কার কী ভূমিকা ছিল তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এজন্য একটি (অঘোষিত) কমিটি করে দিয়েছে দলীয় হাইকমান্ড।

দলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে আন্দোলন কর্মসূচিতে দলীয় নেতাদের ভূমিকা মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নানা মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করছেন তিনি। সুবিধাবাদী ও পদলোভী নেতাদের অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। পাশাপাশি দলের প্রকৃত ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের যথাযথ মূল্যায়নের ব্যাপারেও তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ।

এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক আন্দোলনে যারা সঠিক ভূমিকা পালন করেননি, ইচ্ছা করেই দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে যারা ত্যাগ স্বীকার করে মাঠে থেকে আন্দোলন করেছেন এবং স্ব স্ব অবস্থান থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন যথাযথ মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এতে দেশব্যাপী সব নেতা-কর্মী উৎসাহ লাভ করতে পারেন বলে তারা মনে করছেন।
জানা গেছে, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন-পূর্ব আন্দোলনে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় নতুন করে দলের সব পর্যায়ের কমিটিগুলো ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ছাত্রদল-যুবদলের কমিটি ভেঙে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। জেলা পর্যায়ে নতুন কমিটি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে আসন্ন রমজান মাস থেকে। এ মাসকে দলটি সংগঠন পুনর্গঠনের মাস হিসেবে কাজে লাগাতে চায়। পাশাপাশি বিএনপিতে ফিরতে ইচ্ছুক নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ের ধারাবাহিক বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দায়িত্বশীল নেতাদের মতে, চলমান আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত না হলেও হতাশার কোনো কারণ নেই। বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণ বর্জন করেছে। এখন পুনরায় নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে। এ কারণেই দলকে নতুন নেতৃত্বে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দল পুনর্গঠন একটি স্বাভাবিক ও চলমান প্রক্রিয়া। যোগ্য ও ত্যাগীদের নেতৃত্বে আনাটাই একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ছাড়া আন্দোলন-সংগ্রামসহ সাংগঠনিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে যারা ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকারপূর্বক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন- তাদের মূল্যায়ন করাটাই স্বাভাবিক বিষয়। কোনো দলকে রাজনৈতিক সুফল পেতে হলে এটা করতেই হবে।

দলের ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিক দল ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কমিটিগুলো গঠন-পুনর্গঠন করা হবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া দলের প্রকৃত ত্যাগী, দক্ষ, যোগ্য ও সক্রিয় নেতাদের যথাযথ মূল্যায়নই করাটাই সবার কাম্য।

দলের দাফতরিক সূত্রমতে, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে সারা দেশে বিএনপির ২৭ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় গ্রেফতার এড়াতে বাকি নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। দলীয় নেতা-কর্মীদের দমনপীড়নের মুখে ফেলে কেউ কেউ ‘সেফ-এক্সিট’ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। ঘুরেফিরে অল্প কিছু সংখ্যক নেতা হরতাল-অবরোধের সমর্থনে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করেন। এ চিত্র রাজধানী ঢাকা থেকে দলের তৃণমূল পর্যন্ত সর্বত্র বিদ্যমান। হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও নেতা-কর্মীরা প্রত্যাশা অনুযায়ী আন্দোলনে মাঠে নামেননি। অনেকে আবার নিজে তো যান-ই নি, উপরন্তু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নাম ভাঙিয়ে দলীয় নেতা-কর্মী, সমর্থকদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন বলেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। অপর এক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত ছাত্র ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়ার। এ দুটি সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা নেতাদের সাম্প্রতিক ‘পারফরম্যান্সে’ দলীয় হাইকমান্ড সন্তুষ্ট নন। এ ছাড়াও একই অভিযোগে ইতিপূর্বে জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। দলের মূল্যায়ন, বিক্ষিপ্তভাবে পাঁচ/দশজন কর্মী-সমর্থক নিয়ে পৃথক মিছিল বের করা হলেও বিগত আন্দোলনে একত্রে মাঠে নামতে পারেননি গুরুত্বপূর্ণ এই দুই (ছাত্র ও যুবদল) সংগঠনের নেতারা। সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বে সমন্বয় ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া জেলা বিএনপির নেতাদের সঙ্গেও কেন্দ্রীয় নেতাদের তেমন একটা সমন্বয় ছিল না বলেও হাইকমান্ডের কাছে অভিযোগ করেছেন তারা।

জানা গেছে, যুব ও ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্বে যারা আছেন নতুন কমিটিতে এবার তাদের রাখার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। সরাসরি নতুন নেতৃত্ব আনা হতে পারে। এর প্রাথমিক প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এর ফলে অনেক নেতাই যেমন ছিটকে পড়তে পারেন, তেমনি অনেকে আবার নতুন কমিটিতে সামনে চলে আসতে পারেন। এতে রাজপথে সক্রিয় থাকা সাবেক ছাত্রনেতাদের ভাগ্য খুলে যেতে পারে।

জানা যায়, সারা দেশে বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে আন্দোলনে ২০-২৫টি জেলার কার্যক্রম/ভূমিকা সন্তোষজনক ছিল না। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কেবল এসব জেলা ও মহানগরে দল ও অঙ্গ-সংগঠনের কমিটি ভেঙে রাজপথে সক্রিয় নেতাদের দিয়ে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেওয়া হতে পারে। দলীয় সূত্র জানায়, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ নানা কারণে বিভিন্ন সময় বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতাদেরও এবার দলে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকমান্ড। এক্ষেত্রে ২৮ অক্টোবরের পর থেকে আন্দোলনে যেসব নেতা নিজেরা সরাসরি মাঠে সক্রিয় ছিলেন কিংবা তাদের অনুসারী নেতা-কর্মীরা রাজপথে ছিল এবং আন্দোলনজুড়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করেছেন, তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে। তাদের পদোন্নতি দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিভিন্নভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন দলীয় হাইকমান্ড তারেক রহমান। সঠিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী তিনি অবশ্যই ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের আগামীতে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights