যে জয়ে পরান জুড়ায়

রাশেদুর রহমান

মেঘের আঁধার সরে গেল রাওয়ালপিন্ডির আকাশ থেকে। হাসলো সূর্য। তার সঙ্গে হাসলো পুরো বাংলাদেশ। পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের বিশ্বখ্যাত পেস আক্রমণকে চোখ রাঙিয়ে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ জিতে ইতিহাস গড়ল টাইগাররা। হোয়াইটওয়াশ করল পাকিস্তানকে। অবিস্মরণীয় এক জয়ের সাক্ষী হলো নতুন বাংলাদেশ।

‘মেঘ দেখে তুই করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’। কেবল সূর্যই তো নয়, বাংলাদেশের মানুষও হাসে। সোমবার বিকালে রাওয়ালপিন্ডির আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। বাংলাদেশের ব্যাটারদের রানের গতি থামিয়ে দেয়। বুক ধুকপুক করতে থাকে সমর্থকদের। খেলাটা হবে কি! কালও (মঙ্গলবার) বৃষ্টির চোখ রাঙানি থাকবে না তো! একসময় বাংলাদেশের সমর্থকরা টেস্ট ম্যাচে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতেন। বৃষ্টিতে দু-একদিন ভেসে গেলে ম্যাচটা ড্র করার সুযোগ বাড়ত। সেই সমর্থকরাই বৃষ্টি না আসার প্রার্থনা করছেন। বাংলাদেশে দিনকাল সত্যিই বদলে গেছে।

পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানকে পরাজিত করার গুপ্ত বাসনা নিয়েই যাত্রা করেছিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। তাদের মনে ছিল ২০০৩ সালে মুলতানে অধরা জয়ের সেই আফসোস। ইনজামাম উল হক একাই যে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের কাছ থেকে। এরপর টেস্ট ক্রিকেটে আরও বেশ কয়েকবারই মুখোমুখি হয়েছে দুই দল। পাকিস্তানই জয় পেয়েছে বেশির ভাগ। দুটি টেস্ট ড্র করেছে বাংলাদেশ। সেই নিয়েও তৃপ্তি ছিল। পাকিস্তান ক্রিকেটের অভিজাত সদস্য। বিশ্বকাপ জয় করা দল। টেস্ট ক্রিকেটেও তাদের রয়েছে আধিপত্য। চোখ রাঙিয়ে ক্রিকেট খেলে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারতের মতো দলের সঙ্গে। সেই দলটাকে তাদেরই মাঠে ধবলধোলাই দেওয়ার মতো ঘটনা সত্যিই তৃপ্তিদায়ক। যেখানে একটা জয় কিংবা ড্রও ছিল বড় প্রাপ্তি সেখানে ধবলধোলাই! বিস্ময়ের ঘোর কাটবে কী করে!
একসময় ক্রিকেটের মোড়লরা বলতেন, বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিল না টেস্ট স্টেটাস। সেই আলোচনটা এখন আর শোনা যায় না। তবে বাংলাদেশের টেস্ট খেলার সমালোচনা মাঝেমধ্যেই হয়ে থাকে। কখনো অস্ট্রেলিয়া কখনো ইংল্যান্ডের পণ্ডিতরা ক্রিকেট নিয়ে দীক্ষা দেন। পাকিস্তানের পেস রাজ্যে আক্রমণ চালিয়ে একে একে দুটি টেস্ট ম্যাচ জয়ের পর তাদের বোধোদয় হবে হয়তো! তবে ক্রিকেটারদের মনে এসব হয়তো আর দাগ কাটে না। পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলাতেই কি দূরন্ত সাহস দেখিয়েছেন তারা! ২৬ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর ইনিংসটা এত লম্বা হবে কেউ ভেবেছিল! মেহেদী হাসান মিরাজ আর লিটন দাসের ইনিংস দুটি বড় দলের নামের পাশেই তো মানায়। অস্ট্রেলিয়া ৬টি উইকেট হারালেও তাদের সমর্থকদের কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা দেখা যায় না। ৭, ৮, ৯ এমনকি ১০ নম্বরের ওপরও তাদের আস্থা থাকে। বাংলাদেশও তাই করে দেখাচ্ছে। তাও পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণ সামলে নিয়ে! বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালেরও। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘এটা স্রেফ অসাধারণ। ২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে সেখান থেকে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়! কী দারুণ ঘুরে দাঁড়ানো! দলকে বড় অভিনন্দন। এটা অনেক দিন স্মরণ রাখা হবে।’

বাংলাদেশ আগেও টেস্ট সিরিজ জয় করেছে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৪-০৫, ২০১৪-১৫, ২০১৯-২০ ও ২০২১ সালে চারবার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০০৯ ও ২০১৮-১৯ সালে দুইবার। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২০২২-২৩ সালে ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২০২৩ সালে একবার করে। প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশও করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ দাপটের সঙ্গে জয় করার সঙ্গে কোনোটারই তুলনা চলে না। সত্যি বলতে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের যত অর্জন এটা থাকবে শীর্ষ সারিতে! ম্যাচসেরা হয়ে লিটন দাস বললেন, ‘এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় অর্জন।’ সিরিজসেরার ট্রফি হাতে মেহেদী হাসান মিরাজ বললেন, ‘এই মুহূর্ত কখনো ভুলব না।’ সত্যিই তো এমন জয় কখনো ভোলার নয়।

দেশের মাটিতে জাতীয় ক্রিকেট দল অনুশীলন শুরু করেছিল গত মাসে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনুশীলন ঠিকভাবে করা হয়নি। এলোমেলো ছিল সবকিছু। তবে পাকিস্তানে গিয়ে অনুশীলনের সেই ঘাটতি দূর করে নেন টাইগাররা। তার প্রমাণ দিলেন মাঠেই। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা ছিল তাদের। নতুন বাংলাদেশে নতুন কিছু করার তাড়না ছিল। দেশের মানুষের মাঝে নতুন আশা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় ছিল। সে সবকিছু ঠিকঠাক করেছেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। এবার সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়। অর্জন ধরে রাখাই তো আসল চ্যালেঞ্জ। সামনেই ভারতের বিপক্ষে অ্যাওয়ে সিরিজ। সেখানেও এবার টাইগারদের কাছ থেকে ভালো কিছুই আশা করবেন সমর্থকরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights