শিশুশ্রম নিরসন করে শিশুদের দক্ষ কারিগরে রুপান্তরিত করতে হবে

শিশুরাই একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের কারিগর। শিশুদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটানো আমাদের সকলের দায়িত্ব। কেননা সঠিকভাবে শিশুদের বিকাশ ঘটলেই একটি নির্মল পৃথিবী গড়ে তুলতে তারা সক্ষম হবে। শিশুদের ও জাতির ভবিষ্যৎ আলোকিত করার জন্য দরকার সুষ্ঠুভাবে শিশুদের মেধার বিকাশ ঘটানো, লেখাপড়া, খেলাধুলা ও বেড়ে ওঠা সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলা। আর আজকের শিশুদের এই মৌলিক মানবিক বিষয়গুলোর সুষ্ঠু বিকাশে গুরুত্বারোপ করতে হবে। কিন্তু শিশুদের সুস্থ ও সুন্দর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্যতম একটি অন্তরায় হয়ে উঠেছে শিশুশ্রম। শিশুশ্রম হলো যে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক বা অন্যান্য কার্যকলাপ যা শিশুর নিয়মিত স্কুল যাওয়া এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধনে বাধাগ্রস্ত করে। উপার্জনের উদ্দেশ্যে অপ্রাপ্ত বয়সে করা কায়িকশ্রম কিংবা অর্থের বিনিময়ে করা কাজ শিশুশ্রমের আওতাধীন। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হলো শিশুশ্রম। আর বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম বহুমাত্রিক একটি সমস্যা হলো শিশুশ্রম। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা নিয়মিত শিশুশ্রমের ও একইসাথে শিশুশ্রমিক নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই। এই শিশুশ্রম আমাদের দেশ ও জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ যা দ্রুত নিরসন করা অতীব জরুরি। শিশুশ্রম নিরসন করতে এবং শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টায় সকলের সক্রিয়তা আনতে ২০০২ সালের ১২ই জুন সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে। এরপর থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশ সহ জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো দিবসটি পালন করে আসছে।

শিশুশ্রম একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশ ও এই সমস্যার বাইরে নয়। বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অন্যতম প্রধান কারণ হলো দরিদ্র্যতা বা আর্থ-সামাজিক দুরবস্থা। সেই সাথে শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশ সম্পর্কে সামাজিক অসচেতনতা ও শিশুশ্রমের একটি অন্যতম কারণ। দেশে চলমান প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনা শিশুদের কায়িকশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে গ্রামে বসবাসরত পরিবারগুলো থেকে উঠে আসা শিশুশ্রমিকের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। গ্রামে কাজের অপ্রতুল সুযোগ, সামাজিক অনিশ্চয়তা, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ, সর্বোপরি মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাবে গ্রামীণ পরিবারের পিতাদের পাশাপাশি শিশুদেরও উপার্জনের জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে লিপ্ত করা হয় যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশে বাঁধা প্রদান করে। এছাড়াও গ্রামে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে অসচেতনতা অতিরিক্ত সন্তান জন্মদানের অন্যতম কারণ, যা পরবর্তীতে পরিবারের দারিদ্র্য অবস্থা তৈরি করে এবং শিশুরা বাধ্য হয়ে লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কর্মে যোগদান করে। তাছাড়াও কাজের তাগিদে অনেক শিশুকে গ্রাম থেকে শহরমুখী করা হয় যারা নিজের পরিবার ও স্বাভাবিক বিকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শহরের হোটেল-রেস্তোরা কিংবা ফ্যাক্টরি-ওয়ার্কশপে উপার্জনের জন্য আবদ্ধ হয়ে পড়ে৷

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সালে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩২ লাখ। এই সংখ্যা ২০২৩ সালে কমিয়ে আনা হয়েছে ১৭ লাখে এবং ২০২৪ সালে এই সংখ্যা আরো কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে বর্তমান সরকার। এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম পুরোপুরি নির্মূল করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এ নিদৃিষ্টভাবে বলা হয়েছে ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নেওয়া যাবে না। এছাড়া শিশুশ্রম নিরসনে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত সনদে বাংলাদেশের সাক্ষর রয়েছে। শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের গৃহীত বেশকিছু পদক্ষেপ যেমন: সামাজিক সচেতনতা, শিশুর বিকাশে নীতিমালার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদির বাস্তবায়ন শিশুশ্রম কমিয়ে আনতে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। তবে শিশুশ্রম নিরসন যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং দেশ ও জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ, তা আমরা অনেকেই অবহেলার চোখে দেখি। শিশুর জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রাথমিক বয়য়ে তারা বিদ্যালয় মুখী না হয়ে শ্রমমুখী হওয়ার ক্ষতিকর দিকটি আমরা অনেকে কর্ণপাত পর্যন্ত করিনা। এই অবহেলা থেকে বেরিয়ে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি সচেতনতা বৃদ্ধি করলে তা শিশুশ্রম নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আজকের শিশুদের দক্ষ মানবসম্পদে রুপান্তর করতে আগামীর ভবিষ্যৎ দেশ ও জাতির উন্নয়ন বয়ে আনতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পারে দেশ থেকে শিশুশ্রম পুরোপুরি নির্মূল করে শিশুদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে যা আগামীতে দেশকে উন্নতির চরম শেখরে পৌঁছে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সিদরাতুল মুনতাহা
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
সভাপতি, জবি ফিচার কলাম অ্যান্ড কন্টেন্ট রাইটার্স
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
০১৩০৮৫৬১৪৬৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights