ইসলামে ভ্রাতৃসংঘাত নিষিদ্ধ

আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভি (রহ.)

মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের তিন দশক অতিক্রম না করতেই মুসলিম বিশ্বে ভ্রাতৃসংঘাতের সূচনা হয়, যা এখন পর্যন্ত চলমান। ইসলামবিরোধী নানা সংঘ, গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা মুসলিম জাতির বিমুখতা—এসব সংঘাতের পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে এবং করছে। অথচ ইসলাম ভ্রাতৃসংঘাতের মতো আত্মঘাতী কাজকে প্রথম থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

মুসলমানের নিরাপত্তা

কোনো প্রকার সংশয় ও মতবিরোধ ছাড়াই প্রমাণিত—শরিয়তে এক মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের রক্তপাত হারাম বা নিষিদ্ধ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এক মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও সম্ভ্রম সর্বতোভাবে হারাম।’

(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)

হত্যাকাণ্ড কুফরির পথ দেখায়

কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য মতে, এক মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমকে হত্যা করা কবিরা গুনাহ এবং তা কুফরির দিকে নিয়ে যায়। মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়েছেন। আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম; যেমন—আজকের এদিন, এ মাস ও এ শহর তোমাদের জন্য সম্মানিত। উপস্থিত ব্যক্তিরা যেন এসব কথা অনুপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেয়।’

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭)

ভ্রাতৃসংঘাত মূর্খদের কাজ

মহানবী (সা.) মুসলিম জাতিকে জাহেলিদের যুগের মূর্খদের মতো পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। যারা পরস্পরে ওপর চড়াও হতো ধন-সম্পদের মোহে অথবা গোত্রীয় বিদ্বেষের কারণে, বা কোনো নেতা বা প্রবীণ ব্যক্তির ডাকে সাড়া দিয়ে অথবা কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বা এমন অন্য কোনো কারণে।

জাহেলি যুগে ভ্রাতৃসংঘাতের চিত্র

ইসলামপূর্ব জাহেলি আরবে একটি উটকে কেন্দ্র করে দুটি গোত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিল। তাদের এই সংঘাত অব্যাহত ছিল ৪০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে। একটি উটের জন্য বনু বকর ও বনু তাগলিবের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল ‘হারবুল বাসুস’। এমন দুটি সম্প্রদায় যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, যারা সম্পর্কে পরস্পরের চাচাতো ভাই। প্রবৃত্তি, শত্রুতা, বিদ্বেষ তাদের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল, দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ইসলাম আগমনের আগে মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে বহু বছর যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।

ইহুদিরা তাদের মধ্যে যুদ্ধের আগুন উসকে দিত। তারা একেক সময় একেক গোত্রের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে বিজয়ী হতে সাহায্য করত। ইহুদি গোত্রগুলোর কতক আউসের মিত্র আর কতক খাজরাজের মিত্র ছিল।

অন্যায় পক্ষাবলম্বন নিষিদ্ধ

জাহেলি যুগে মানুষ ন্যায় ও অন্যায়ের বিবেচনা না করে নিজ দলের পক্ষে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হতো। তাদের স্লোগান ছিল তোমার ভাই অত্যাচারী হোক, অত্যাচারিত হোক সর্বাবস্থায়, তাকে সহযোগিতা করো। অর্থাত্ বিবাদের সময় তার পক্ষালম্বন করবে সে সত্যপন্থী হোক বা অন্যায়কারী হোক। কতিপয় গোত্রপ্রধানের ব্যাপারে বলা হতো—‘সে ক্রোধান্বিত হলে তার সঙ্গে ১০ হাজার ঘোড়সওয়ার ক্রোধান্বিত হয়। তারা জিজ্ঞেসও করে না সে কোন বিষয়ে ক্রোধান্বিত হয়েছে।’

ভ্রাতৃসংঘাত কুফরিতুল্য অপরাধ

বিদায় হজে পারস্পরকি সংঘাত ও বিবাদের মাধ্যমে জাহেলি যুগে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার পর তোমরা কুফরির দিকে ফিরে যেয়ো না যে তোমরা একজনের ঘাড়ে অপরজন আঘাত করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭০৭৭)

হাদিসের অর্থ হলো—কোনো মুসলিমকে আঘাত করা কুফরিসদৃশ কাজ বা তা কুফরির দিকে নিয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি (পাপ) আর তাকে হত্যা করা কুফরি।’

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭০৭৬)

আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন দুজন মুসলিম পরস্পরের দিকে তরবারি ওঠায়, তখন হত্যাকারী ও নিহত উভয়ে জাহান্নামে যাবে। সাহাবির বলল, হে আল্লাহর রাসুল! হত্যাকারীর বিষয়টি ঠিক আছে, কিন্তু নিহত ব্যক্তি? তিনি বলেন, কেননা সে তার সঙ্গীকে হত্যার ইচ্ছা পোষণ করত। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪১২২)

রাসুলুল্লাহ (সা.) শুধু হত্যাকেই নিষিদ্ধ করেননি, বরং হাসির ছলেও কোনো মুসলিমের দিকে অস্ত্র দিয়ে ইঙ্গিত করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের দিকে অস্ত্র উঠিয়ে ইশারা না করে। কেননা সে জানে না হয়তো শয়তান তার হাতে ধাক্কা দেবে এবং সে জাহান্নামের গর্তে পতিত হবে।’

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭০৭২)

মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দাবি

এই ভ্রাতৃত্বের দাবি হলো—ভালোবাসা, সমতা, সহযোগিতা, সাহায্য ও অভিভাবকত্ব। তা নিষেধ করে শত্রুতা, বিদ্বেষ, বিচ্ছিন্নতা, বিশৃঙ্খলা ও সংঘাতে লিপ্তকে। তারা পরস্পরের ক্ষেত্রে তরবারি কোষবদ্ধ রাখবে। এ জন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা অনুমান থেকে বেঁচে চলো। কেননা অনুমান বড় মিথ্যা ব্যাপার। আর কারো দোষ খুঁজে বেড়িয়ো না, গোয়েন্দাগিরি কোরো না, পরস্পরকে ধোঁকা দিয়ো না, আর পরস্পর হিংসা কোরো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ কোরো না এবং পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ কোরো না, বরং সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৬৬)

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) হিংসা-বিদ্বেষকে মুসলিম উম্মাহর ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তার ক্ষতি ও ভয়াবহতার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের দিকে পূর্ববর্তী উম্মতের ব্যাধি ধেয়ে আসছে। তাহলো হিংসা ও বিদ্বেষ। বিদ্বেষ হলো মুণ্ডনকারী। আমি চুল মুণ্ডানোর কথা বলছি না, কিন্তু তা দ্বিনকে মুণ্ডিয়ে দেয়।’

(মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৪১২)

মহানবী (সা.) আরো বলেন, ‘একজন মুমিন আরেকজন মুমিনের জন্য ইমারতস্বরূপ, যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে। এ কথা বলে তিনি তাঁর হাতের আঙুলগুলো একটার মধ্যে আরেকটা প্রবেশ করালেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৮১)

মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে নবীজি (সা.) বলেন, ‘পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মুমিনদের একটি দেহের মতো দেখবে। যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশ নেয়।’

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০১১)

ভাষান্তর : আলেমা হাবিবা আক্তার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights