উদ্বেগ বাড়াচ্ছে গুপ্তঘাতক আর্সেনিক

জিন্নাতুন নূর

বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক পানীয় জলেই বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে বলে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বিজ্ঞানীদের একটি দল বলছে, প্রায় ৮ কোটি বাংলাদেশি ক্ষতিকর মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক পিএলওএস ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে আসে। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের ২০১৯ সালের গুচ্ছ জরিপের তথ্য বলছে, দেশের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। সে হিসাবে প্রায় ২ কোটি মানুষ এই পানি পান করছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দেশে ২০১৮ সালের পর থেকে আর্সেনিক রোগী শনাক্ত করা এবং বিনামূল্যে তাদের সেবা দেওয়ার কার্যক্রম স্থগিত আছে। যা দেশের জনস্বাস্থ্য সংকটকে আরও প্রকট করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় মানুষের ত্বক, মূত্রাশয় এবং ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ আর্সেনিক দূষণ ঠিকই গুপ্তঘাতকের মতো মানুষের ক্ষতি করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আজ সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও বিশ্ব পানি দিবস পালন করা হচ্ছে। এবার দিবসটির থিম ‘ওয়াটার ফর পিস’।

‘সি লেভেল রাইস ফ্রম ক্লাইমেট চেঞ্জ ইস এক্সপেকটেড টু ইনক্রিস দ্য রিলিজ অব আর্সেনিক ইনটু বাংলাদেশ’স ড্রিঙ্কিং ওয়েল ওয়াটার বাই রিডাকশন অ্যান্ড বাই দ্য সল্ট অ্যাফেক্ট’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়, আর্সেনিকের এই বর্ধিত মাত্রা সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং আরও গুরুতর মৌসুমি বন্যার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এতে দেখা যায়, দেশের ভূগর্ভস্থ পানির প্রায় ৪৯ শতাংশে আর্সেনিকের ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত নিরাপদ সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

মূলত আর্সেনিক হচ্ছে পৃথিবীর ভূ-ত্বকের মধ্যে পাওয়া একটি প্রাকৃতিক উপাদান, যা মারাত্মক বিষও বটে। নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত আর্সেনিক খাবার পানির সঙ্গে মিলে দূষণ সৃষ্টি হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা প্রতি লিটারে ০.৫ মিলিগ্রাম। যখনই এর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় তখনই তা মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু এই সমীক্ষায় কিছু নমুনায় আর্সেনিকের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ৪৫০ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকার চেয়ে কয়েক গুণেরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনাকাক্সিক্ষত বন্যা এবং জলবায়ু উত্তপ্ত হওয়ার কারণে সৃষ্ট চরম আবহাওয়া দেশের পানীয় জলে আর্সেনিকের বিপজ্জনক মাত্রার নির্গমনকে বেগবান করবে। এরই মধ্যে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় লাখ লাখ মানুষের ত্বক, মূত্রাশয় এবং ফুসফুসের ক্যান্সার হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে আর্সেনিকযুক্ত পানি খেলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব শরীরে দেখা যায়। জ্বর, বমি, মাথাব্যথা, শরীরে অস্বাভাবিক ব্যথা, রক্ত আমাশয় এবং উদরাময়কে এ রোগের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় আর্সেনিকযুক্ত পানি খেলে রোগীর গায়ে কালো কালো দাগ দেখা দেয় বা চামড়ার রং কালো হয়ে যায়। হাত ও পায়ের তালু শক্ত খসখসে হয়ে যায়। ছোট ছোট শক্ত গুটির মতো দেখা দেয়। ধীরে ধীরে গায়ের চামড়া মোটা ও খসখসে হয়ে যায়।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের দেশের নলকূপে আর্সেনিকের মানমাত্রা নিয়ে করা সমীক্ষার তথ্য বলছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে আর্সেনিকের হার সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে আছে চাঁদপুর, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী. নোয়াখালী, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও সাতক্ষীরা জেলা। এসব এলাকার নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ বেশি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেল) মো. সাইফুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা সময়ে সময়ে নতুন নলকূপ হলে তা পরীক্ষা করে দেখি। ২০২২ সালে আমাদের একটি স্ক্রিনিং শেষ হয়েছে। দেশের গ্রাউন্ড ওয়াটারে আর্সেনিক থাকার বিষয়টি জিওলজিক্যাল। দেশে আর্সেনিক অতীতে ছিল, এখন আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এমনটি পৃথিবীজুড়ে হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights