থমকে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের মামলা

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মাদক মামলা থমকে যাচ্ছে সিমের ভুয়া রেজিস্ট্রেশনে। বাংলাদেশিদের নামে ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করা সিম কার্ড দিয়ে রোহিঙ্গারা মাদকের অন্ধকার জগৎ নিয়ন্ত্রণ করলেও আইনি জটিলতায় মাদকের সঙ্গে জব্দ করা মোবাইল ও সিম অন্তর্ভুক্ত করা হয় না জব্দ তালিকায়। ফলে এসব মামলায় আসামি করা যাচ্ছে না মাদকের ক্রেতা-বিক্রেতাদের। তাই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো চালানের ক্যারিয়ারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক জাফর উল্ল্যাহ কাজল বলেন, ‘রোহিঙ্গা মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করা সিম কার্ডগুলো বাংলাদেশিদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা। অন্যজনের নামে সিম রেজিস্ট্রেশন করার কারণে মাদক মামলায় তদন্তে ব্যাঘাত ঘটে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যারিয়াররা চালানের ক্রেতা-বিক্রেতাদের বিস্তারিত বলতে পারে না। কিংবা দিতে চায় না। তাই মামলার চার্জশিট ক্যারিয়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়।’

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘এ পর্যন্ত ইয়াবাসহ গ্রেফতার রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে প্রচুর মোবাইল ফোনও জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু মোবাইল ফোনে ব্যবহার করা সিমগুলো রেজিস্ট্রেশন ছিল বাংলাদেশি নাগরিকের নামে। তাই বেশির ভাগ মামলায় মাদকের বাহক বা ক্যারিয়ারকে আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হয়।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথের অন্যতম প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাখাইন স্টেটের রাজধানী ‘সিত্তে’ এবং ‘মংডু’কে। মায়ু পর্বতমালা এবং নাফ নদ অতিক্রম করে টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ সাগরপথে মাদকের চালান দেশে প্রবেশের পর চলে যায় কক্সবাজারের ৩২ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে পরে তা ছড়িয়ে যায় পুরো দেশে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সারা দেশে মাদক ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। মাদকের বাহক হিসেবে কাজ করা রোহিঙ্গারা যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করেন বাংলাদেশিদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির সিম। চালান আনা-নেওয়ার পথে বাহকরা ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গত সাত বছরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগ ও কক্সবাজার পুলিশ ৩ হাজার ৯০০ রোহিঙ্গাকে মাদকসহ গ্রেফতার করে। যাদের কাছ থেকে ৩ হাজারের অধিক বিভিন্ন কোম্পানির সিম উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ৪৯২টি মামলায় ৬৩২ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০২২ সালে ১৪৭ মাদক মামলায় আসামি করা হয় ১ হাজার ৫২৪ জনকে। ২০২১ সালে ৬০৫ মাদক মামলায় আসামি করা হয় ৬৩০ জন রোহিঙ্গাকে। ২০২০ সালে ৫৩৮ মাদক মামলায় আসামি করা হয় ৫৩২ জনকে। ২০১৯ সালে ১৭৮টি মাদক মামলায় আসামি করা হয় ২৭৪ জনকে। ২০১৮ সালে ১২৪টি মাদক মামলায় আসামি করা হয় ১৯০ জনকে। ২০১৭ সালে ৩৫টি মামলায় আসামি করা হয় ৫৩ জনকে। এ বিষয়ে আইন প্রয়োগকারীর সংস্থার হাতে গ্রেফতার হওয়া একাধিক রোহিঙ্গা জানান, তাদের সঙ্গে থাকা সিম সরবরাহ করে মাদক পাচার চক্রের মূল সদস্যরা। তারা ক্যারিয়ারকে মাদকের চালানের সঙ্গে একটি কম দামি মোবাইল সেট ও সিম দেয়। সঙ্গে দেওয়া হয় মাদক চালানের প্রাপকের মোবাইল নম্বর। এরপর ক্যারিয়ারকে তুলে দেওয়া হয় যাত্রীবাহী বাসে। বাস গন্তব্যে পৌঁছালে মাদকের চালানের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয় মোবাইলও। মাদক ক্যারিয়ারের পক্ষে চালানের প্রেরক ও প্রাপক কারওই বিষয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ থাকে না। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর অঞ্চলের উপপরিচালক হুমায়ন কবির খন্দকার বলেন, ‘রোহিঙ্গা মাদক ব্যবসায়ীরা অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা করছে। অনেক সময় মাদকের সঙ্গে মোবাইলও জব্দ করা হয়। কিন্তু রোহিঙ্গারা গ্রেফতারের পর মোবাইল নিজের বলে স্বীকার করে না। একই সঙ্গে আইনি জটিলতার কারণে তা জব্দ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights