ফগ লাইটে অনীহা, প্রতিদিন সড়কে মৃত্যুর মিছিল

অনলাইন ডেস্ক
ঘন কুয়াশায় সড়কে যান চলাচলে ফগ লাইট ব্যবহারের রীতি থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ফগ লাইটের দাম মোটেও বেশি নয়। তারপরও যানবাহনের মালিক কিংবা চালকরা এ ব্যাপারে উদাসীন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি শীত মৌসুমে গত ডিসেম্বরের শুরু থেকে দেশজুড়ে ঘন কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে।

যানবাহনে ফগ লাইট না থাকায় গত ডিসেম্বরে এমন একটি দিনও যায়নি, যেদিন ঘন কুয়াশার কবলে পড়ে দ্রুতগতির যানবাহন দুর্ঘটনা ঘটায়নি।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে দেশে মোট ৫০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৩৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ৭৬৪ জন। এসব দুর্ঘটনার বেশির ভাগ ঘটেছে যানবাহনে ফগ লাইট না থাকায়।

অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ১৫২টি পরিবার।

গত ১৫ ডিসেম্বর বরগুনার আমতলী-পটুয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে সুরভী পরিবহনের একটি দূরপাল্লার বাস ঘন কুয়াশার মধ্যে দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে রিমা আক্তার (৪১) নামের এক নারী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আর আহত হয় শিশু ও নারীসহ আরও চারজন।

ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই দিন ভোর ৫টার দিকে আমতলী-পটুয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে আমতলীর তুলার মিল এলাকায় বাসটি ঘন কুয়াশার কারণে দুর্ঘটনায় পড়ে।

আরেক ঘটনায় গত শুক্রবার ভোরে যাত্রী নিয়ে একটি মিনিবাস ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থেকে ঢাকার দিকে আসছিল। বাসটি শ্রীনগর থানার হাসাড়া যাত্রীছাউনির সামনে পৌঁছানোর পর সামনে থাকা একটি কাভার্ড ভ্যানকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই বাসের সুপারভাইজার ও হেলপার নিহত হন। পুলিশ জানায়, ওই সময় এক্সপ্রেসওয়েতে ছিল প্রচণ্ড কুয়াশা।

যে কারণে পেছন থেকে আসা দ্রুতগতির বাসের চালক সামনে ধীরে চলা কাভার্ড ভ্যানটিকে দেখতে পাননি। ফলে ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা।

আবার গত বছর ১১ ডিসেম্বর সকালে নওগাঁর পোরশা এলাকায় প্রবল কুয়াশার মধ্যে দ্রুতগতিতে একটি বাস চালিয়ে যাচ্ছিলেন চালক। সকাল ৬টার দিকে পোরশা-নওগাঁ আঞ্চলিক সড়কের মাটিন্দর ব্রিজের কাছে পৌঁছলে বাসটি উল্টে যায়। এতে নূর বানু নামের এক বৃদ্ধা নিহত হন। পোরশা থানার ওসি শাহীন রেজা জানান, কয়েক দিন ধরে ওই অঞ্চলের পুরো এলাকা ও সড়ক ঘন কুয়াশায় ঢাকা। ঘন কুয়াশার কারণেই বাসটির নিয়ন্ত্রণ হারান চালক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন কুয়াশার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর কোনও পদক্ষেপ নেই। বাস মালিক ও চালকরাও উদাসীন। কুয়াশার মধ্যে চলতে ফগ লাইট ব্যবহার করলে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। কিন্তু এক-দুই হাজার টাকা মূল্যের ফগ লাইট কিনে ব্যবহার করতে যানবাহন মালিকদের অনীহার শেষ নেই।

তারা আরও বলছেন, কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমার সমস্যা হওয়ায় চালকদের মধ্যে ঝুঁকি তৈরি হয়। এ কারণে শীত মৌসুমে দেশে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। তবে চালক বা পরিবহন মালিকরা এগুলোকে ঝুঁকি মনে করেন না। এক্সপ্রেসওয়েগুলোতেও তারা কুয়শার মধ্যেও সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালান। ফলে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।

তবে বাস মালিকরা বলছেন, দেশে ভালো মানের ফগ লাইট পাওয়া না যাওয়ায় তারা সেটি ব্যবহার করছেন না। ফলে কুয়াশার সময় হেডলাইট জ্বালিয়ে রাখতে নির্দেশ দেওয়া আছে চালকদের।

শীত মৌসুমে কুয়াশার কারণে বছরের অন্য সময়ের চেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে উল্লেখ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, “কুয়াশার সময় ধীরগতিতে গাড়ি চালানোর নির্দেশনা রয়েছে, যে নির্দেশনা মানা হয় না। ফগ লাইট ব্যবহার করলে কুয়াশার মধ্যে অনেক দুর্ঘটনা কমে। কিন্তু কেউ সেটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না।”

তিনি বলেন, “হেডলাইটের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হলুদ আলোর ফগ লাইট, যেটার আলোতে অনেক দূর পর্যন্ত চালক দেখতে পান।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ও শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, “বাংলাদেশে যে ফগ লাইটগুলো পাওয়া যায় সেগুলো নিম্নমানের, যে কারণে লাগানো হয় না। তবে আমরা চালকদের নির্দেশনা দিয়ে রেখেছি যাতে দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালায়। কুয়াশায় হেডলাইট কাজ করে।”

বিষয়টি নিয়ে হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি দেলোয়ার হোসেন মিঞা বলেন, “আমরা সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। এই সময়ে এসে কুয়াশার কারণে রোড অ্যাকসিডেন্ট বাড়ছে। গত ক’দিনে দেখা গেছে, এক্সপ্রেসওয়েতে ট্রাক ধীরগতিতে চলছে। আর পেছন থেকে দ্রুতগতির বাস এসে তাতে ধাক্কা দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এসব কারণে আমরা এক্সপ্রেসওয়েতে সমগতিতে যানবাহন চালানো এবং গাড়ি না থামানোর নির্দেশ দিয়েছি। কুয়াশার মধ্যে গাড়ি থামানো থাকলে আরেকটি দ্রুতগামী গাড়ি এসে ধাক্কা দেওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা অনেক মামলা দিচ্ছি। এছাড়া নির্দেশ দেওয়া রয়েছে, কুয়াশার সময় দৃষ্টিশক্তি অনুযায়ী গাড়ি চালাতে হবে। প্রয়োজনে ১০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাবে।”

ফগ লাইটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সরকারি গাড়িগুলোয় ফগলাইট ব্যবহার করা হয়। আমরা ব্যক্তিমালিকানাধীন যানবাহনেও দ্রুত ফগ লাইট ব্যবহারের নির্দেশনা দেব।”

ফগ লাইট বিক্রি প্রতিষ্ঠান বাইক বাজারের অনলাইন থেকে জানা যায়, হাইওয়েতে তীব্র কুয়াশা বা মুষলধারে বৃষ্টির সময় ফগ লাইট আলোর অভাব দূর করে। তীব্র কুয়াশা ভেদ করে চলার পথকে দৃশ্যমান করে। এমনকি হেডলাইটের আলো যদি কমও হয়, ফগ লাইট সে আলোর স্বল্পতা দূর করে। মোটরসাইকেলের একটি ফগ লাইটের দাম ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকা। আর বড় যানবাহনের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ফগ লাইটের দাম দুই হাজার টাকা। এর চেয়ে কম দামেও ফগ লাইট কিনতে পাওয়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

What do you like about this page?

0 / 400

Verified by MonsterInsights