বসুন্ধরা কিংসের দৃষ্টি আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনে

ইকরামউজ্জমান

স্বাধীন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে ‘পাইওনিয়ার’ হিসেবে প্রথম ‘করপোরেট কালচার’ ও পেশাদার মোড়কে মোড়ানো ফুটবল দল বসুন্ধরা কিংস। দলটির মাঠে আত্মপ্রকাশের পেছনে আছেন বৃহৎ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়াপিপাসু চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের খেলার প্রতি উৎসাহ, আগ্রহ ও ভালোবাসা। বাবা থেকে শুরু করে সন্তানরা সবাই স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। ফুটবলকে দেশে ও দেশের বাইরে দেখতে চান ভালো অবস্থায়।

দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটি ঘিরে আছে তাঁদের ভিশন—নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বসুন্ধরা পরিবারের সব সদস্যের রক্তে মিশে আছে খেলাধুলা।
‘ভালো বিদেশি ও দেশি খেলোয়াড়দের নিয়ে যদি দল গঠন করা সম্ভব হয় তা হলে দর্শকরা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দলের খেলা মাঠে দেখতে আসবে, এতে মাঠ প্রাণ ফিরে পাবে’—বসুন্ধরা গ্রুপের চৌকস কর্মযোগী, যিনি ফুটবল অন্তপ্রাণ, অবসর পেলেই মাঠে খেলতে নামেন এবং খেলাটা উপভোগ করেন, ইমরুল হাসানের এই বক্তব্যে আস্থা রেখেই গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের ‘সবুজ সংকেতের’ মাধ্যমেই বসুন্ধরা কিংস বড় মাঠে দাপটের সঙ্গে যাত্রা শুরু করে। ‘জেনেরিক’ দল হিসেবে নয়, প্রথম থেকেই বসুন্ধরা কিংসকে ‘ভ্যালু অ্যাডেড’ একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে কাজ করা হয়েছে।

দেশের ফুটবলে ক্লাব সংস্কৃতিতে ‘হোমওয়ার্ক’-এর মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণের উদাহরণ এটাই প্রথম।
বসুন্ধরা কিংসের দৃষ্টি আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনেবসুন্ধরা কিংসের স্লোগান হলো ‘ইড়ত্হ ঃড় নবধঃ’—‘জন্ম জয়ের জন্য’। জয় তো শুধু মাঠের লড়াইয়ে নয়, ফুটবলের উন্নয়নে সব প্রতিবন্ধকতার বিপক্ষেও। কিংসের জয় মানে ভালো ফুটবলের জয়।
ফুটবলে নতুন সংস্কৃতির বিকাশ। বসুন্ধরা গ্রুপের দল ‘বসুন্ধরা কিংস’ প্রথম থেকেই দেশের ফুটবলে অন্য অংশীদারদের সঙ্গী করে আলোর পথ ধরে হাঁটতে চেয়েছে। ক্লাব হিসেবে মাঠে অংশগ্রহণ করেই সব দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেনি, দেশের ফুটবল চর্চা চাঙ্গা করার জন্য গ্রুপ বিভিন্ন স্তরের সব ফুটবল লীগ ও টুর্নামেন্টের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। বসুন্ধরা চেয়েছে, প্রথম থেকেই দেশের ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হতে!
পাঁচ বছরে আটটি ট্রফি জয়। এর মধ্যে ২০১৯-২০ মৌসুমে করোনা মহামারির কারণে খেলা পরিত্যক্ত হয়েছে।

একনাগাড়ে চার মৌসুম প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা দখলে রাখার অসাধারণ সাফল্য। ২০২২-২৩ মৌসুমে বসুন্ধরা কিংস চতুর্থবারের মতো প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা জয়ের পর ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বসুন্ধরা কিংসকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাফুফের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রেরিত অভিনন্দনপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘পুরো দলের কঠোর পরিশ্রম, প্যাশন ও নিষ্ঠা না থাকলে এই শিরোপা অর্জন সম্ভব হতো না। সবাই এ নিয়ে গর্বিত হতে পারে। এই অসাধারণ অর্জনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আমার অভিনন্দন।’
ফুটবলের দৌলতে দেশের বাইরের জগৎ বসুন্ধরা গ্রুপ সম্পর্কে জানতে পারছে। কিংস ক্লাব বসুন্ধরার জন্য বিশাল ব্র্যান্ডিং। সচেতন মহল এ বিষয়টি গুরুত্ব ও আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করে। ভারতের বেঙ্গালুরুতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ১৪তম সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের স্পন্সর ছিল বসুন্ধরা গ্রুপ। তারা চ্যাম্পিয়নশিপের নামকরণ করেছে ‘বঙ্গবন্ধু সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৩’।

গত জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রিত স্পোর্টস কলামিস্ট, ফুটবল লেখক ও বিশ্লেষকদের ওয়ার্কশপে ‘কেস স্টাডির’ একটি সেশনে পেশাদার ফুটবলের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বসুন্ধরা গ্রুপের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফুটবলে ক্লাব পর্যায়ে শত শত কোটি অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে আধুনিক স্পোর্টস কমপ্লেক্স, আন্তর্জাতিক মানের নিজস্ব স্টেডিয়াম সব রকম সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ এবং বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি আর কোনো দেশে কোনো ক্লাব পর্যায়ে কেউ করেনি। আন্তর্জাতিক মানের কাঠামো নির্মাণের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে দেশের বাইরে। বসুন্ধরা কিংসের অত্যাধুনিক এই স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ এবং বিভিন্ন টুর্নামেন্ট ও চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা আয়োজন করা সম্ভব হবে। পেশাদার ফুটবলের জন্য এএফসি ও ফিফার সব ধরনের ‘রিকোয়ারমেন্ট’ বাংলাদেশে প্রথম দল হিসেবে শতভাগ পূর্ণ করেছে শুধু বসুন্ধরা কিংস।

বসুন্ধরা কিংস বাংলাদেশ থেকে প্রথম দল হিসেবে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লীগে দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। প্লে-অফ ম্যাচে ১৫ আগস্ট শারজাহ স্টেডিয়ামে খেলবে একঝাঁক খ্যাতিমান তারকা খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত শক্তিশালী শারজাহ এফসির বিপক্ষে। গ্রুপ পর্বে যেতে হলে বিজয়ী দলকে আরেকটি ‘প্লে-অফ’ পার হতে হবে। সেটি আগামী ২২ আগস্ট ইরানের ‘ট্রাক্টর’ ক্লাবের বিপক্ষে। এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ সব সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এখানে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। বসুন্ধরা কিংসের জন্য অংশগ্রহণ বড় একটি চ্যালেঞ্জ। সঠিক পজিশনে সঠিক খেলোয়াড় অন্তর্ভুক্ত করে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে ক্লাব। কোচ অস্কার ব্রুজোন প্রথম থেকেই আছেন দলের সঙ্গে। তিনি পেরেছেন দলের সব খেলোয়াড় নিয়ে এক সুতোয় মালা গাঁথতে। ব্রুজোন ইতিবাচক টেকনিক্যাল পারসন। ক্লাব পরিচালনা পরিষদ তাঁর ওপর আস্থা রেখেছে।

নতুন ক্লাব হিসেবে মাঠে নেমে সফলতার মুখ দেখেছে বসুন্ধরা কিংস। ঘরোয়া ফুটবলে জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী দলগুলোকে পেছনে ফেলে কিংস এগিয়ে চলেছে। কিংসের সফলতার পেছনে আছে পেশাদার নির্বাহীদের দ্বারা ক্লাব পরিচালনা। এই দক্ষ জনশক্তি তাদের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নতুন চিন্তা-ভাবনা ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে দল পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিংসের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপের ম্যানেজমেন্টের সব ধরনের সহযোগিতা ক্লাব পরিচালনার ক্ষেত্রে। তাদের লক্ষ্য একটাই, সবার প্রচেষ্টায় জেগে উঠুক দেশের ফুটবল।

ধারাবাহিকতার সঙ্গে ঘরোয়া ফুটবলে শিরোপা জয়, দলে ভালো কার্যকরী বিদেশি খেলোয়াড় অন্তর্ভুক্তি ক্লাবের সমর্থক ও ভক্ত বাড়াতে সাহায্য করছে। একটি দীর্ঘ সময় ধরে দেশের ফুটবলে দুটি আবেগময়ী নাম ছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ও আবাহনী। এখন দুটি নামের সঙ্গে আরেকটি আবেগময়ী নাম সংযুক্ত হয়েছে—বসুন্ধরা কিংস। ভালো খেলা উপহারের মাধ্যমে ফুটবল মাঠে আবার দর্শক ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কিংসের সভাপতির কথা হলো, প্রচুর অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে বিদেশি নামি খেলোয়াড় আনলেই শিরোপা জেতা যায় এই ধারণা ভুল। আসল বিষয়টি হলো পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স। মনে রাখতে হবে, স্ট্রাইকাররা গোল করে আর শিরোপা জেতায় ডিফেন্ডাররা। হাতে খেলা বাকি থাকতে বসুন্ধরা কিংস চ্যাম্পিয়ন হয়েছে (২০২২-২৩) চতুর্থবারের মতো। এটা সম্ভব হয়েছে সেরা দল হিসেবে, সেরা খেলোয়াড় দলে আছে বলে নয়।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৪৮ থেকে ২০২৩। ৭৫ বছর। সর্বোচ্চ পর্যায়ে ফুটবলে নতুন দল হিসেবে প্রথমবারের মতো লীগ খেলতে নেমে একনাগাড়ে পর পর চার মৌসুম শিরোপা জিতে এক অনন্য নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে দেশের বৃহত্তর করপোরেট গ্রুপ বসুন্ধরার পৃষ্ঠপোষকতায় ফুটবল দল বসুন্ধরা কিংস। ঘটনাবহুল ঢাকার ফুটবল লীগে গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে একমাত্র বসুন্ধরা কিংস ছাড়া আর কোনো ফুটবল ক্লাব এ ধরনের গৌরবে গৌরবান্বিত হতে পারেনি। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই, অখণ্ড ভারতবর্ষে ঢাকার ফুটবল লীগ শুরু হয়েছে ১৯১৫ সালে। ১৯১৫ থেকে ২০২৩। ১০৮ বছর। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে নবাগত দল হিসেবে প্রথমবার খেলতে নেমে একমাত্র বসুন্ধরা কিংস ছাড়া আর কোনো ফুটবল ক্লাব একনাগাড়ে চার মৌসুম চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাসে নাম লেখাতে পারেনি।

বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট ইমরুল হাসান জানিয়েছেন, তাঁদের তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনার অনেক কিছুই এরই মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে, যা সচেতন মহলের অজানা নয়। ঢাকার ফুটবল লীগে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। এখন দলের লক্ষ্য কলকাতার ফুটবল লীগ। এই লীগে প্রথমবারের মতো খেলতে নেমে মোহামেডান স্পোর্টিং ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে টানা পাঁচ বছর শিরোপা জিতেছে। বাংলাদেশে বসুন্ধরা কিংস প্রথমবারের মতো খেলতে নেমে (২০১৮-১৯) টানা শিরোপা জিতেছে চারবার। এখন লক্ষ্য হলো ২০২৩-২৪ মৌসুমে পাঁচবারের মতো শিরোপা জিতে কলকাতা মোহামেডানের রেকর্ডের সমকক্ষ হওয়া এবং পরের ২০২৪-২৫ সালে ষষ্ঠবারের মতো জিতে উপমহাদেশের ফুটবলে নতুন একটি রেকর্ড সৃষ্টি। বসুন্ধরা কিংস সব সময় স্বপ্ন দেখে এবং বড় স্বপ্ন দেখে। তিন বছর মেয়াদি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যে বিষয়টিকে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব হচ্ছে সেটি হলো নিজস্ব একাডেমির কার্যক্রম শুরু করা। স্পোর্টস কমপ্লেক্সের মধ্যে নিজস্ব স্টেডিয়ামের কাছে একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণের কাজ চলছে। এই অবকাঠামোর কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দল নিয়ে কাজ শুরু হবে। বিদেশি কোচ দিয়ে বয়সভিত্তিক দলকে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এতে বসুন্ধরা কিংসের পাইপলাইনে ভালো স্থানীয় খেলোয়াড়ের সমস্যা আর থাকবে না। এ ছাড়া পেশাদার ফুটবলে তৈরি খেলোয়াড়কে অন্য ক্লাবেও বিক্রি করতে পারবে। একাডেমির খেলোয়াড়রা পরিপক্ব হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights