ভ্যাটে অসন্তোষ জনমনে
মানিক মুনতাসির
শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং সরকারি চাকুরেদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে- সরকারের এমন ঘোষণায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ছাত্র ও সাধারণ জনতা এক অপ্রত্যাশিত আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে হটিয়ে ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় এনেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার তার পুরস্কার হিসেবে শতাধিক পণ্যের ভ্যাট বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের বোঝা বাড়িয়ে দিলেন অর্থনীতির বিপর্যয়কর এক সময়ে। ভ্যাট বৃদ্ধির মতো বিষয় এ রকম বিপর্যস্ত সময়ে সাধারণ মানুষের কাছে কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। এর মাধ্যমে সরকার নিজেই মূল্যস্ফীতির অগ্নি অবস্থাকে আরও উসকে দিল বলে তিনি মনে করেন।
বেসরকারি খাতের একজন চাকরিজীবী হারুন অর রশিদ বলেন, এই আন্দোলনে সরকারি চাকুরেদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। বরং তারা ছিল ওই স্বৈরাচারের দোসর হিসেবেই। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পাঁচ মাসের মাথায়ই সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর (মহার্ঘ ভাতা) ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এমনকি এটাকে খুবই যৌক্তিক বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে তীব্র অসন্তোষ জানিয়েছেন রিকশাচালক আনিসুর রহমান। তিনি খিলগাঁও এলাকায় বসবাস করেন। আনিসুর রহমান বলেন, শুনলাম সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়বে। তাহলে আমাদের রিকশা
ভাড়া কি বাড়বে? না হলে তো আমরা আর বাঁচতে পারব না। এমনিতেই তো মাছ-মাংস কেনা বন্ধই করে দিয়েছি।
ব্যাংক কর্মকর্তা রাশেদুর রহমান বলেন, সরকার যেখানে সাধারণ মানুষের কথা ভাবার কথা সেখানে সাধারণ মানুষের খরচ বাড়িয়ে দিল। আর আয় বাড়িয়ে দিল সরকারি চাকুরেদের। তাহলে তো এটা আর সাধারণ মানুষের সরকার থাকল না। আন্দোলন করি আমরা সাধারণ মানুষ আর ঘি খায় স্বৈরাচারের দোসররাই। এদিকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে অসময়ে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়িয়েছে সরকার। যদিও পরে দু-একটি পণ্যের ব্যাপারে ভিন্ন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে তা প্রত্যাহারের সার্কুলার জারি করা হয়নি। এতে করে অর্থবছর শেষে সরকারের কোষাগারে অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা জমা হবে। যদিও এটা করা হয়েছে আইএমএফের শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে। অবশ্য আইএমএফ বলেছিল করজাল বিস্তৃত করার মাধ্যমে রাজস্ব বাড়াতে। আর সরকার শর্টকাট পথ বেছে নিয়ে করের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। যা মানুষের জীবন যাত্রায় ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। এর চূড়ান্ত প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর বেতন বাড়িয়ে ১৮ মানুষের ওপর ভোগান্তি বাড়িয়ে দিল সরকার। অথচ এ সরকার বলছে, তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেটা কীভাবে হয়- প্রশ্ন তুলে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, একটা পক্ষের আয় বাড়ানো হলো। আর বাকি ১৮ কোটি মানুষের ব্যয় বাড়িয়ে দেওয়া হলো। এটাই তো সবচেয়ে বড় বৈষম্য। কেননা, সরকারি চাকরিজীবীদের তুলনায় তো দিনমজুর/শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম। অন্তর্বর্তী সরকার মহার্ঘ ভাতা দিয়ে আবারও সেই সরকারি চাকুরেদের ক্রয়ক্ষমতা আরও এক দফা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আর সাধারণ মানুষের ক্ষমতা আরও কমবে। এতে করে মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে আরও বেশি জর্জরিত হবে সাধারণ মানুষ বলে তিনি মনে করেন।
অর্থবিভাগ বলছে, ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীকে মূল বেতনের সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর জন্য এক বছরে সরকারের বাড়তি খরচ হবে অন্তত ৭ হাজার কোটি টাকা। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বাড়তি ব্যয় কোনোভাবেই যৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
কয়েক বছর ধরেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে গত জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে ঘিরে অস্থিতিশীলতায় সরকারের রাজস্ব আহরণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। তাই সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই হোটেল-রেস্তোরাঁ, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ওষুধ, কোমল পানীয়সহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনশীল মুদ্রানীতির পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ে কাটছাঁট করার কথা বলা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এখনই মহার্ঘ ভাতা দেওয়াটা যৌক্তিক সময় নয়। অন্তর্বর্তী সরকার অরাজনৈতিক হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। যা সাধারণ মানুষের জন্য মোটেও কল্যাণকর নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।