রাষ্ট্র না বদলালে সমাজ বদলাবে না

আদর্শভিত্তিক রাজনীতি, সুশাসন ও দেশের উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলে। আদর্শচ্যুত রাজনীতির কাছ থেকে সমাজ ও দেশ কিছু আশা করতে পারে না। তাতে বরং গণতান্ত্রিক চর্চা বিঘ্নিত হয়। স্বাধীনতার সাড়ে পাঁচ দশক পেরিয়ে আসার পরও দেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। রাজনীতিতে আদর্শ, জনকল্যাণ, আত্মত্যাগ ও নৈতিকতা ক্রমে দুর্বল হয়েছে। এক পর্যায়ে রাজনীতি হয়ে ওঠে বিত্ত-বৈভব অর্জনের হাতিয়ার। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের বর্তমান বাস্তবতা, রাজনীতির ভবিষ্যৎ—নানা বিষয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

বাংলাদেশে তরুণরা, বিশেষ করে ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

ঘটনাটি ঘটিয়েছে তরুণরাই। অতীতে বড় বড় ঘটনা ঘটেছে ছাত্র-জনতার ঐক্যের ভিত্তিতেই; যেমন—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান। শেখ হাসিনার পতনও তরুণদের শুরু করা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ঘটল।

কিন্তু আসলে ঘটেছেটা কী, সেটার বিবেচনাও জরুরি। কেউ বলছেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা, কারো ধারণা আরো অগ্রসর, বলছেন বিপ্লবই ঘটে গেছে। বাস্তবে কিন্তু দুটির কোনোটি ঘটেনি। যেটা ঘটেছে তা হলো, নৃশংস একটি সরকারের পতন।

আর এই পতন অনিবার্য করে তুলেছে সরকার নিজেই। বিগত সরকার ছিল চরম ফ্যাসিবাদী এবং শেষের দিনগুলোতে তার আচরণ ছিল অবিশ্বাস্য রকমের নৃশংস। সরকারের নৃশংসতা ও মনুষ্যত্বের অপমান সরকারের পতন নিশ্চিত করেছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সরকারবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকাও কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।

বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে তারা সরকারের জনবিচ্ছিন্নতাকে স্পষ্ট করে তুলেছিল। সরকারের পতন অবশ্যই ঘটত। সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে সরকার যদি সরে যেত, তাহলে এত মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটত না; সরকারকেও দেশ ছেড়ে পালাতে হতো না। তারা বিরোধী দল হিসেবে থাকতে পারত। চরমপন্থার চরম ফল ঘটেছে।

জনগণের রাজনীতি কি দেশে দেখতে পাচ্ছেন?

না, সে অর্থে দেখা যাচ্ছে না। বুর্জোয়ারা বৈষম্যবিরোধী নয়, তারা বৈষম্য সৃষ্টি ও লালন-পালনের পক্ষে; আন্দোলন করতে হবে প্রকৃত বৈষম্যবিরোধীদের, অর্থাৎ সমাজতন্ত্রীদের। সমাজতন্ত্রী, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষরা যদি একটি সুনির্দিষ্ট ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে, তাহলে মানুষের সাড়া পাওয়ার পাশাপাশি তারা অসম্ভবকে সম্ভব করার দিকে অগ্রসর হতে পারবে। এই যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের মতো পাঁচমিশালি হবে না; তবে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক ও সমাজতন্ত্রীদের সমন্বয়ে হতে হবে। বুর্জোয়ারা নয়, জনগণের রাজনীতি করবে সমাজে যারা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চায়, সেই বাম গণতান্ত্রিক শক্তি।

দেশে রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী দেখতে পাচ্ছেন? পরমতসহিষ্ণুতার দিন কি ফিরবে?

পরমতসহিষ্ণুতা বাড়বে না, বরং কমবে। নির্বাচন হলে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারাও বুর্জোয়াই। বুর্জোয়ারা তো রাজনীতি করে ক্ষমতার জন্য। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তারাও অসহিষ্ণু হবে বলে আশঙ্কা। সম্পদ পাচারে তারা যদি আগের সরকারের মতো তৎপর না হয় তো ভালো। কিন্তু মুনাফালিপ্সা তাদের অব্যাহতি দেবে না। ব্যবসায়ী ও আমলারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকবে, আগে যেমন ছিল। উন্নতির পুঁজিবাদী ধারাও অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা করি। ফলে বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা এবং দেশপ্রেমের নিম্নগামিতা অব্যাহত থাকবে। রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সমাজ পরিবর্তনকারীদের রাজনৈতিক ভূমিকার ওপর।

গত ১৫ বছর দেশে যে শাসনকাঠামো চলেছে, সেটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

গত ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল। সেই পুলিশকেই জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে লেলিয়ে দেওয়া হয়। দলীয় ক্যাডারদেরও কাজে লাগানো হয় আন্দোলনকারীদের নির্যাতন করতে। সরকারের সবচেয়ে ওপরে থাকা প্রধানমন্ত্রী—তাঁর দম্ভ বাড়তে বাড়তে হয়ে উঠেছিল আকাশচুম্বী। তাঁর একক স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্বে যেটা সবচেয়ে বেশি জাজ্বল্যমান হয়েছে সেটা হচ্ছে প্রতিশোধস্পৃহা। তাঁর প্রতিশোধপরায়ণতায় দেশে নৈরাজ্য, লুণ্ঠন, অগণতান্ত্রিকতা ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়েছিল। দলবাজি, চাঁদাবাজি চরম আকার ধারণ করেছিল।

দেশের মানুষ তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আরো এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু রাষ্ট্র কি সেই সুযোগ করে দিতে পারছে?

আগেই বলেছি, বুর্জোয়া শাসকরা বৈষম্যবিরোধী নয়। মানুষের এগিয়ে যাওয়ার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে বৈষম্য। এই বৈষম্য নিরসন না হলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এর জন্য উন্নতির ধারায় পরিবর্তন আনা চাই। উন্নতি পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে জনগণের কাঁধে চড়ে বসবে না; উন্নতি হওয়া চাই নদীর মতো সৃষ্টিশীল, সর্বত্রগামী এবং উপকারী। এর জন্য রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্রের মালিকানা হবে জনগণের। সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য থাকবে; ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে। এবং সর্বত্র জবাবদিহিমূলক জনপ্রতিনিধিত্বের শাসন থাকা চাই। এটা এমনি এমনি ঘটবে না; এর জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দরকার হবে।

পাকিস্তান আমলের জাতীয়তাবাদী শক্তি আর এখনকার জাতীয়তাবাদী শক্তিতে পার্থক্য রয়েছে। রাষ্ট্রের চরিত্র কি কিছু পরিবর্তিত হয়েছে?

জাতীয়তাবাদীদের একটা সীমা আছে। তাদের পরিসরটা একটা গণ্ডিতে আবদ্ধ। ক্ষমতাপ্রাপ্তিই তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য। সেটা পেলে তারা ওখানেই থেমে পড়ে। আর অগ্রসর হয় না। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ছিল ধর্মাশ্রয়ী। সেটা প্রত্যাখ্যান করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান। দুটির মধ্যে মিল ও অমিল নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ যে ধরনেরই হোক, সে শ্রেণি মানে না। বলে সবাই সমান। ভাই ভাই। সুবিধাভোগী ধনীরা মেহনতিদের শোষণ করে, অথচ উন্নতি যা ঘটে তা মেহনতিদের শ্রমের কারণেই। জাতীয়তাবাদ তার এই চরিত্রটা বদলাতে পারে না। আর রাষ্ট্রের চরিত্র? সেটা তো আগের মতোই পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিকই রয়ে গেছে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে পেছনে ঠেলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ক্রমেই চাঙ্গা হচ্ছে।

রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে পরিবর্তনটি ঘটেছে, তা কি সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে? আপনার কী মনে হয়?

রাষ্ট্রের মৌলিক ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। গত ৫৩ বছরে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে মাত্র। ঘটেছে শাসকদের নাম ও পোশাক পরিবর্তন। রাষ্ট্রের চরিত্রে যে পরিবর্তন, সেটা শতকরা ২০ জনের সুবিধা বৃদ্ধি করেছে, ৮০ জনকে বঞ্চিত করে। রাষ্ট্রীয় শাসক আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ক্রমাগত নিষ্ঠুর হয়েছে। বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সমাজের মৌলিক পরিবর্তনে মোটেই সাহায্য করবে না, বরং তার বিরোধিতা করবে। কারণ রাষ্ট্র তো একটি ব্যবস্থা বৈকি, যা তার মালিকের সেবা করে। রাষ্ট্রের বুর্জোয়া মালিকরা নিশ্চয়ই বৈষম্য দূর করতে চাইবে না। তারা তাদের মুনাফা ও ক্ষমতা বাড়ানোতে তৎপর থাকবে। ফলে সমাজের অবস্থা আরো খারাপ হওয়ার কথা। আশার জায়গাটা হবে (যদি হয়) সমাজ পরিবর্তনকামীদের রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ। বর্তমান মুহূর্তে সুযোগ এসেছে সমাজ পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের। এই যুক্তফ্রন্ট হবে আন্দোলনের, তবে যুক্তফ্রন্ট আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনেও অংশ নেবে। মানুষ হতাশায় ভুগছে, যুক্তফ্রন্ট মানুষকে আশাবাদী ও ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে।

আমরা শিক্ষা নিয়ে কথা বলি। শিক্ষাকে চিন্তার বিকাশের সহায়ক করে গড়ে তোলা কিভাবে সম্ভব?

শিক্ষাকে সর্বজনীন করার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে মাতৃভাষার মাধ্যমে একমুখী শিক্ষা। শিক্ষার ত্রিধারা ব্যবস্থা শ্রেণিবৈষম্যের প্রতীক। সেক্যুলার, গণমুখী, সুলভ, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত ও মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপন ও রণকৌশল গ্রহণ করা দরকার। শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ডসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এবং শিক্ষা আদর্শনিরপেক্ষ হবে না। আদর্শটা হবে মনুষ্যত্বের বিকাশ। সে জন্য শিক্ষা যেমন জ্ঞান দেবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের সামাজিকও করে তুলবে। শুধু বুদ্ধির বিকাশ নয়, চাই হৃদয়েরও শিক্ষা। শিক্ষার্থী যাতে আত্মকেন্দ্রিক ও মুনাফালিপ্সু না হয়ে পড়ে সেটা দেখতে হবে। ঘরের শিক্ষা কিন্তু শিক্ষার্থীদের অসামাজিক ও আত্মকেন্দ্রিক করছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা হবে সামাজিকতার। আত্মকেন্দ্রিকতা যাতে প্রশ্রয় না পায় সেটা দেখা চাই। সংস্কৃতির চর্চা ও খেলাধুলা হবে শিক্ষার অংশ।

সমাজ ভাঙার যে লড়াই, সেটা তো দীর্ঘমেয়াদি। এই লড়াইয়ের জন্য যে মানসিকতা, সেটা কি আমাদের আছে?

সমাজ বদলের অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষের সংখ্যা কমেছে, কিন্তু নিঃশেষ হয়নি। এই লড়াই বিভিন্ন পন্থায় অব্যাহত রয়েছে। সমাজের বেশির ভাগই ভালো মানুষ। কিন্তু তারা সংগঠিত নয়। তাদের দল নেই। দল গঠনের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি নেই। মানুষ তো মানুষই থাকবে না, যদি তার মনুষ্যত্ব হারায়। এবং মানুষ নিশ্চয়ই মনুষ্যত্ব হারাতে রাজি হবে না। প্রয়োজন বিবেকবান ও বুদ্ধিমান মানুষদের এগিয়ে আসা।

ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ সব সময় এক ধরনের চাপের মুখে থাকছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান কেমন? ভবিষ্যতে কেমন হওয়া উচিত?

আমাদের ভূখণ্ডটি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর কাছে এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিষয়টি বারবার সংবাদে এসেছে। চাপ বাড়ছে শাসকশ্রেণির দুর্বলতার কারণে, যারা নিজেদের স্বার্থ দেখে, দেশের স্বার্থ না দেখে। দেশের স্বার্থ হওয়া চাই পররাষ্ট্রনীতির প্রথম শর্ত। সেটা থাকলে কূটনৈতিক দক্ষতা বাড়ে এবং নতজানু না হওয়ার মনোভাব তৈরি হয়। কতিপয়ের স্বার্থে পররাষ্ট্রনীতির নির্ধারণ দেশদ্রোহের শামিল। সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ ও আনুগত্যের কারণে এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার ফলে তাদের কর্তৃত্বের জন্য সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দেশের সম্পদ যারা বিদেশে পাচার করে তারা তো দেশের স্বার্থ দেখবে না, দেখছেও না।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ধরনের পরিবর্তন আসছে। সেখানে নতুন কোনো পরিস্থিতি কি আপনার কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে?

আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজিবাদী বিশ্বের বিকল্প এখন আর নেই। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র মুনাফার জন্য যুদ্ধ বাধায়। অস্ত্র বিক্রি করে মুনাফার লোভে। ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালায়। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। দুই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র আমেরিকা ও রাশিয়া এখন পৃথিবীকে ভাগ করে তাদের বলয়ের বাইরে কোনো রাষ্ট্রকে রাখার পক্ষপাতী নয়। পুঁজিবাদী চীনও বসে নেই। তারাও মুনাফার জন্য বাণিজ্যিক বিস্তার ঘটিয়ে চলছে। আমাদের মতো ছোট ও দুর্বল দেশকে তারা কবজার মধ্যে রাখতে চায়। আন্তর্জাতিক পরিবর্তন কোনো ইতিবাচক বার্তা আনছে না, নেতিবাচক খবরই দিচ্ছে শুধু। বিশ্ব এগোচ্ছে ফ্যাসিবাদের দিকে। এর জন্য প্রতিটি দেশের মানুষের কর্তব্য রুখে দাঁড়ানো।

রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ ভাবনা কী?

রাষ্ট্র ও সমাজ বদলানো ছাড়া আমাদের ভবিষ্যৎ বদলাবে না। রাষ্ট্র সমাজের চেয়ে শক্তিশালী, তাই রাষ্ট্র না বদলালে সমাজ বদলাবে না। আমাদের এই রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক প্রয়োজনে গঠিত। তাই রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন শুধু আবশ্যিকই নয়, অপরিহার্যও বটে।

জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তির প্রত্যাশা নিয়ে বরাবর আপনি কথা বলেছেন এবং এখনো সেই চরিত্রই বহনকারী জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তি নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?

জনগণের মুক্তির প্রধান অন্তরায় পুঁজিবাদসৃষ্ট বৈষম্য। বৈষম্যের অবসান এবং ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তি নিশ্চিত হবে। সংস্কারে কুলাবে না। সেটা ভেঙে পড়বে। সংকটের স্থায়ী নিরসনে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।

বিকল্প রাজনীতি ছাড়া সমাজের মুক্তি সম্ভব নয়—এ কথাও বলেছেন আপনি। এই বিকল্প রাজনীতি কেমন হতে পারে?

বিকল্প রাজনীতি হতে হবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বিদায় করে সামাজিক মালিকানার বিশ্ব গড়ে তোলার রাজনীতি। সে জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় সংস্কার নয়, সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন হবে। রাজা ও প্রজার সম্পর্ক ছিন্ন করে, বৈষম্য ঘুচিয়ে ফেলে, প্রতিষ্ঠা করা চাই প্রকৃত সাম্য ও মৈত্রী। তার জন্য সামাজিক বিপ্লব ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই।

রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা কি খুব সহজ হবে?

না, সহজ হবে না। কাজটি কঠিন, কিন্তু অসাধ্য নয়। এর জন্য দেশপ্রেমিক মানুষদের ঐক্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন। এই দুটি জিনিস এখন অনেকটা অনুপস্থিত। তবে এটিও বলা যাবে যে শেখ হাসিনার সরকারের পতনটা এভাবে যে ঘটবে সেটা কেউ চিন্তাও করেনি। কিন্তু সেটা ঘটেছে। রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনও যে ঘটানো যাবে না, সেটা ভাবি কী করে? নিজেদের বাঁচার জন্যই রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ঐক্যেই সেটা সম্ভব হবে বলে আশা রাখি। মানুষের অসাধ্য বলে তো কিছু নেই।

এটা তো খুবই বড় চ্যালেঞ্জ?

অবশ্যই। তবে আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বিদায় করেছি। বিদায় করেছি পাকিস্তানিদেরও। স্বাধীনতার আগে ও পরে আমাদের অর্জনগুলো আমলে নিলে পরিষ্কার হয়ে যাবে, আমাদের দেশের মানুষ শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই জয়ী হয়েছে।

কাজটা কঠিন। কিন্তু বিকল্প পথ কি খোলা আছে?

কঠিন নিশ্চয়, আর বিকল্প বলতে নিশ্চয়ই বুর্জোয়াদের থেকে কিছু আশা করা যাবে না। যারা সমাজ পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ তারাই বিকল্প পথের দিশা দিতে পারবে, অন্য কেউ নয়।

ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে আপনি কেমন দেখতে চান?

দেখতে চাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ হিসেবে। বৈষম্যহীন এবং সব মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য নিশ্চিতকারী একটি সমাজ চাই, যে সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি। অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তির সংগ্রাম চলছে এবং চলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights