হাঁপানি ও কাশিজনিত হৃদরোগ

ডা. এম শমশের আলী

দীর্ঘদিন থেকে হাঁপানি রোগে ভুগছেন, দীর্ঘদিন থেকে কাশিজনিত সমস্যাসহ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এবং অন্য আরও অনেক ফুসফুসের অসুস্থতাজনিত সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তি কোনো একপর্যায়ে এসে এ ধরনের মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

মানুষের হৃৎপিন্ডে দুটি পার্শ্ব আছে। ডানপাশ ও বামপাশ। দুটি পাশ সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু একই হৃৎপিন্ডে তাদের অবস্থান। ডানপাশে অপরিশোধিত রক্ত থাকে। সুতরাং ডানপাশ পরিশোধনের জন্য রক্তকে ফুসফুসে প্রেরণ করে এবং বামপাশে পরিশোধিত রক্ত থাকে। তাই হৃৎপিন্ডের বামপাশ ফুসফুস ছাড়া সর্ব শরীরে পরিশোধিত রক্ত সঞ্চালন করে। যখন ফুসফুসে রক্তের চাপ বাড়ে তখন ডান পাশের হৃৎপিন্ড আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং যখন শরীরে রক্তচাপ বাড়ে তখন বাম পাশের হৃৎপিন্ড আক্রান্ত হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি হাঁপানি, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টের ফলে ফুসফুসের রক্তনালিতে এক ধরনের স্থায়ী পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে ফুসফুসে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। ফুসফুসের রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে হৃৎপিন্ডের ডানপাশ কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হৃৎপিন্ডের ডান পাশকে অনেক বেশি কর্মসম্পাদন করতে হয়।

এই অসুখে হৃৎপিন্ডের ডান পাশের প্রকোষ্ঠদ্বয় অত্যধিক চাপের মধ্যে কাজ করতে করতে অকেজো হয়ে হার্ট ফেইলুর রোগ সৃষ্টি করে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ রোগকে রাইট সাইডেড হার্ট ফেইলুর বা কোর পালমোনেলি বলা হয়ে থাকে। যে কোনো কারণে ফুসফুস অসুস্থ হয়ে পড়লে ফুসফুসের রক্তনালিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে ফুসফুসের রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের সারা শরীরে যত পরিমাণ রক্ত প্রবাহিত হয় ঠিক তত পরিমাণ রক্ত একটি মাত্র অঙ্গে মানে ফুসফুসে প্রবাহিত হয়। ফুসফুসে এত বেশি পরিমাণ রক্ত সঞ্চালনের জন্য প্রচুর রক্তনালি বিদ্যমান থাকে। তাই ফুসফুসের রক্তনালিতে সমস্যার সৃষ্টি হলে তা দ্রুত ডান পাশের হৃৎপিন্ডকে অসুস্থ করে তোলে। যারা অতিরিক্ত ধূমপান করেন, যারা ধুলোময় পরিবেশে কাজ করেন তাদের ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন ঘটে। যারা ঘন ঘন ঠান্ডাজনিত হাঁচি-কাশিতে ভুগছেন, যাদের বংশগত হাঁপানি আছে, যারা এলার্জিজনিত শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, যারা ব্রংকাইটিস রোগে ভুগছেন। ওপরে উল্লিখেত ব্যক্তিরাই দীর্ঘ সময় পর হার্ট ফেইলুরে আক্রান্ত হবেন। ফুসফুসের সমস্যায় হার্ট আক্রান্ত হলে, কায়িক শ্রম সম্পাদনকালে মাথা হালকা বোধ করা, ভারসাম্যহীনতা বোধ করা, পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা অনুভব করা, মাথা ঘুরানো এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসা, তার সঙ্গে অত্যধিক ঘাম উৎপন্ন হওয়া। ঘামের ফলে পরিধানের কাপড় ভিজে যাওয়া, খুব তাড়াতাড়ি বিশ্রাম গ্রহণ করতে বাধ্য হওয়া এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। তার সঙ্গে বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটার মতো অনুভূতি হওয়ার মতো লক্ষণ থাকতে পারে। ধীরে ধীরে রোগ বাড়তে থাকলে (সময়ের আবর্তে রোগ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে এটাই স্বাভাবিক ধারা) অন্য অনেক ধরনের উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়। যেমন- কায়িক শ্রম সম্পাদনকালে অজ্ঞান অথবা অজ্ঞানমতো হয়ে যাওয়া, বুকে অস্বস্তি বোধ করা, বিশেষ করে বুকের সামনের দিকের মাঝখানে, বুকে ব্যথা হওয়া এবং বুকে চাপ অনুভূত হওয়া, হাত, পা, মুখ ফুলে যাওয়া, পেট ফেঁপে যাওয়া, পেটে পানি জমা হওয়া, পেটে প্রচুর গ্যাস উৎপন্ন হওয়া, ক্ষুধা-মন্দা দেখা দেওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে। এর সঙ্গে যেসব রোগের কারণে এ অসুখ উৎপন্ন হয় যেমন হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি কাশি এগুলো বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ পত্র ব্যবহারের পাশাপাশি বেশ কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলা জরুরি। যেমন- অত্যধিক কায়িক শ্রম ও ভার উত্তোলন পরিহার করা, পার্বত্য এলাকায় ভ্রমণ না করা, নিউমোনিয়া জাতীয় অসুস্থতার জন্য টিকা গ্রহণ করা, ধূমপান সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা, মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা। বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা বা দূষণময় পরিবেশে কাজ না করা। তাই এসব বিষয়ে অবহেলা না করে আমাদের সবাইকে আরও যত্নবান ও সচেতন হতে হবে।
লেখক : হার্ট স্পেশালিস্ট পরিচালক ও চিফ কনসালটেন্ট শমশের হার্ট কেয়ার, শ্যামলী, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights