আল্লাহপ্রেমীদের বিশেষ গুণাবলি

মো. আবদুল মজিদ মোল্লা

আল্লাহর প্রিয় বান্দারা এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকেন, যা তাঁদের আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করে থাকে। আল্লাহপ্রেমীদের এমন সাতটি বৈশিষ্ট্য ও তা অর্জনের পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো—

১. তাওয়াক্কুল : তাওয়াক্কুলের অর্থ আল্লাহর ওপর ভরসা করা। তাওয়াক্কুলের মর্মকথা হলো, একমাত্র কর্মনির্বাহক আল্লাহর ওপর অন্তর থেকে নির্ভরশীল হওয়া। তাওয়াক্কুল আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর কেবল আল্লাহর ওপরই যেন ঈমানদাররা ভরসা পোষণ করে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন চাও, আল্লাহর কাছেই চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করো, আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৬)

অর্জনের উপায় : আল্লাহর অনুগ্রহ, তাঁর অঙ্গীকার ও নিজের অতীত সফলতার কথা স্মরণ করা এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার মাধ্যমে আল্লাহর ওপর আস্থা বৃদ্ধি পায়।

২. মহব্বত : মহব্বত বা ভালোবাসা হলো অন্তরে কোনো কিছুর আকর্ষণ তৈরি হওয়া।

আল্লাহর প্রতি মুমিনের ভালোবাসা এমন তীব্র হয় যে সে অন্তরে আল্লাহপ্রেমের স্বাদ অনুভব করতে পারে। ভালোবাসার আকর্ষণ যখন তীব্র ও শক্তিশালী হয়, তখন তাকে ইশক বলে। মুমিনের সঙ্গে আল্লাহর ভালোবাসার বিবরণ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন এবং তারাও আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসে।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াকে ভালোবাসে, আল্লাহও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াকে ভালোবাসেন।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াকে অপছন্দ করে, আল্লাহও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াকে অপছন্দ করেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫০৫)
অর্জনের উপায় : জাগতিক সম্পর্কগুলো ছিন্ন করা। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর ভালোবাসা মন থেকে বের করে দেওয়া। কেননা দুই বস্তুর ভালোবাসা একত্রে এক অন্তরে জমা হতে পারে না। পাশাপাশি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, তাঁর গুণাবলি ও অনুগ্রহের কথা স্মরণ করা, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা।

৩. শওক : শওক অর্থ অনুরাগ। অনুরাগ হলো কোনো কাঙ্ক্ষিত ও প্রিয় বস্তু, যার কিছুটা জানা আর কিছুটা অজানা, তা পরিপূর্ণভাবে জানা ও দেখার আগ্রহ। মুমিন মহান আল্লাহকে জানা ও তাঁর সাক্ষাৎ লাভে আগ্রহী, সে জান্নাতের নিয়ামতগুলো, যার বর্ণনা কোরআন-হাদিসে এসেছে, তা দেখা ও অর্জনের অনুরাগ পোষণ করে। যেমন পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহর সাক্ষাতের আশা পোষণ করে, তার জন্য আল্লাহর নির্ধারিত সময় অবশ্যই এসেছে।’ (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৫)

মহানবী (সা.) দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার পবিত্র চেহারার দর্শনের স্বাদ এবং আপনার সাক্ষাতের প্রতি অনুরাগ প্রার্থনা করছি।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৩০৬)

অর্জনের উপায় : অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা সৃষ্টির চেষ্টা করা। কেননা ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য অনুরাগ অপরিহার্য।

৪. উনস : উনস হলো কোনো কিছুর প্রতি প্রীত হওয়া অথবা অন্তরে কোনো কিছুর প্রীতি তৈরি হওয়া। উনসের স্বরূপ হলো—যে জিনিস কিছুটা জানা ও স্পষ্ট আর কিছুটা অজানা ও অস্পষ্ট। আর অস্পষ্টতাগুলো দেখে তা জানার ও স্পষ্ট করার আগ্রহ জন্মানকে শওক বলে। আর স্পষ্টতার কারণগুলো দেখে আনন্দ ও প্রফুল্ল সৃষ্টি হওয়াকে উনস বলে। এই আনন্দ অনেক সময় এত দূর প্রবল হয় যে তখন কাঙ্ক্ষিত বস্তুর ‘জালালি সিফাত’ বা বড়ত্ব, মাহাত্ম্য ও তেজোদীপ্ত গুণাবলি ও তার তেজস্ক্রিয়ার বিষয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। ফলে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির কথা ও কাজের মধ্যে কিছুটা অকৃত্রিমতা চলে আসে। একে ইম্বিসাত ও ইদলাল বলা হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি অবতীর্ণ করেছেন।’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যেসব লোক আল্লাহর জিকিরে বসে, রহমতের ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে নেয়, আল্লাহর রহমত তাদের আচ্ছাদিত করে রাখে এবং তাদের ওপর সাকিনা (প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি) অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তাদের কথা তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের মধ্যে আলোচনা করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭০০)

অর্জনের উপায় : উনস যেহেতু ভালোবাসারই প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া, তাই উনস অর্জনের ভিন্ন কোনো পথ নেই। মহব্বত অর্জনের পথেই উনস অর্জিত হয়।

৫. রিদা : রিদা হলো আল্লাহ, তাঁর সত্তা ও গুণাবলি, তাঁর আদেশ-নিষেধ ও তাঁর নির্ধারিত ভাগ্যলিপিতে সন্তুষ্ট হওয়া, বিশেষত আল্লাহর ফায়সালার ব্যাপারে মুখে বা অন্তরে কোনো আপত্তি না করা। কোনো কোনো সময় এ অবস্থা এমন প্রবল হয় যে ব্যক্তি বিপদে-আপদে কষ্ট পর্যন্ত অনুভব করে না। মহান আল্লাহ তাঁর সন্তোষভাজন বান্দাদের সম্পর্কে বলেন, ‘আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০০)

মহানবী (সা.) বলেন, ‘মানুষের সৌভাগ্যের অন্যতম হলো, আল্লাহ তাআলা তার জন্য যে ফায়সালা করেন তার ওপর রাজি ও সন্তুষ্ট থাকা। আর আল্লাহ তাআলার কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা ছেড়ে দেওয়াই হচ্ছে তার দুর্ভাগ্য এবং আল্লাহ তাআলার ফায়সালার ওপর নাখোশ হওয়াও তার দুর্ভাগ্য।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২১৫১)

অর্জনের উপায় : তীব্র ভালোবাসার প্রতিফল রিদা বা আল্লাহর সব কিছুতে সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়া। তাই ভালোবাসা অর্জন ও তার পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমেই ব্যক্তি রিদা অর্জন করতে পারে।

৬. সিদক : সিদক হলো সত্যবাদী হওয়া। মুমিন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসার দাবিতে সত্যবাদী হয়ে থাকে। ইখলাস তথা নিষ্ঠার উন্নত স্তরকেই সিদক বলা হয়। যেন এই ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি না থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই খাঁটি মুমিন তারা, যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে বিশ্বাস করেছে, তারপর আর সন্দেহ পোষণ করেনি এবং নিজেদের জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। তারাই খাঁটি ঈমানদার।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১৫)

অর্জনের উপায় : সব সময় সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমেই ব্যক্তি সিদক অর্জন করে। এ জন্য কখনো নিয়ত বা আমলে ত্রুটি হলে তা সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করে নেওয়া আবশ্যক।

৭. মোরাকাবা : মোরাকাবা হলো অন্তরে সেই মহান সত্তার ধ্যান রাখা যে তার দেখাশোনা করছে, তার প্রতিপালন করছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুর নিরীক্ষক।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১)

মহানবী (সা.) বলেন, ‘তুমি আল্লাহর প্রতি ধ্যান রাখো, তাঁকে তোমার সামনে পাবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৬)

অর্জনের উপায় : এ কথা বিশ্বাস করা যে আল্লাহর আমার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব জানেন। কোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয়। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও অসীম ক্ষমতা এবং শাস্তি ও পুরস্কারের কথা স্মরণ রাখা। নিয়মিত স্মরণ করলে একসময় তা অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যাবে। তখন আল্লাহর ইচ্ছার বিরোধী কোনো কাজ সংঘটিত হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights