গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাচেষ্টা মামলা: পুলিশের থেকে ঘুষ নিচ্ছে পুলিশ

অনলাইন ডেস্ক

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে একটি হত্যাচেষ্টার মামলা বাণিজ্য থেকে রেহাই মিলছে না পুলিশ কর্মকর্তাদেরও। তাই মামলাটি ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছে।

রাজধানীর খিলগাঁও থানায় এই মামলার আসামি ছিলেন আইন ও সালিস কেন্দ্রের চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাঁর নাম প্রত্যাহার করেন বাদী। সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন থেকে শুরু করে ৩৬ জন পুলিশ কর্মকর্তা আসামি রয়েছেন। এর মধ্যে তিন পুলিশ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মামলার আসামি থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য তাঁদের কাছে লাখ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে।

শুধু এ ঘটনাই নয়, রাজধানীর আদাবর থানায় মামলা বাণিজ্য ও আসামিদের হয়রানির কারণে শাহিন পারভেজ নামের এক সাব-ইন্সপেক্টরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সেই তথ্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

গত ১৭ অক্টোবর খিলগাঁও থানায় মো. বাকের নামের এক ব্যক্তি তাঁর ছেলে আহাদুল ইসলামকে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। মামলাটিতে ১৮০ জন আসামির মধ্যে ১ নম্বরে আছেন সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, সাবেক এমপি সাবের হোসেন চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। তা ছাড়া সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদসহ ৩৬ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ২৬ নম্বর আসামি ইন্সপেক্টর পার্থ প্রতিম ব্রহ্মচারী, ৩২ নম্বর আসামি সাব-ইন্সপেক্টর রাশেদুর রহমান এবং ৩৩ নম্বর আসামি সাব-ইন্সপেক্টর অনুপ বিশ্বাস সংবাদমাধ্যমে কথা বলেছেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও তাঁদের অসামি করা হয়েছে। এখন মামলা থেকে নাম কেটে দেওয়ার কথা বলে এক থেকে দুই লাখ টাকা করে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক একটি দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতা ও পুলিশ মিলে মামলা বাণিজ্যের সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। তারা ইন্সপেক্টরদের কাছ থেকে দুই লাখ, সাব-ইন্সপেক্টরদের কাছ থেকে এক লাখ এবং এএসআইদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করছে। না দিলে তাঁদের আরো হত্যা মামলার আসামি করার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

সাব-ইন্সপেক্টর রাশেদুর রহমান জানান, মামলায় উল্লেখিত ঘটনার ১১ দিন আগে তাঁকে রামপুরা থেকে ভাসানটেক থানায় বদলি করা হয়। ভাসানটেক রামপুরা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে এবং এটা সম্ভব নয় যে তিনি রামপুরায় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করতে পারেন এবং একই সময়ে ভাসানটেকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তিনি মামলার নাম কাটাতে টাকা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

একইভাবে ইন্সপেক্টর পার্থ প্রতিম ব্রহ্মচারীও চাঁদা দিতে রাজি নন। তিনি জানান, তাঁর কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে, অন্যথায় ভবিষ্যতে তাঁকে হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার হুমকি দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা জানান, তাঁর কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা চাওয়া হয়েছে। না দিলে পাঁচটি হত্যা মামলা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

এসআই অনুপ কুমার বিশ্বাস গণমাধ্যমকে বলেন, গত ১৮ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ইটের আঘাতে তিনি আহত হন। পরে তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মামলার পর একজন সহকর্মী তাঁকে জানান, এক লাখ টাকা দিতে হবে, নতুবা হত্যা মামলায় জড়ানো হবে। তবে অনুপ নিজেকে অপরাধী মনে না করায় তিনি টাকা দেওয়ার পক্ষে নন।

মামলা দায়েরকারী মো. বাকের (৫২) বনশ্রীতে সবজি বিক্রি করতেন। তিনি একাধিকবার গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, তিনি মামলার আসামিদের চেনেন না। তিনি ছেলের আহত হওয়ার ঘটনায় থানায় অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন। ওই সময় জসিম নামের একজন আইনজীবী এবং আরো কয়েকজন ব্যক্তি এজাহার লিখে দেন এবং তাঁকে স্বাক্ষর করতে বলেন। পরে তিনি স্বাক্ষর করে দেন।

১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩২৬/৩০৭/৫০৬/১০৯/৩৪ ধারায় খিলগাঁও থানায় মামলাটি দায়েরের পর থেকেই সমালোচনা শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার সাব-ইন্সপেক্টর ইমরান হোসেন রবিবার (২৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় বলেন, ‘বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা জড়িত কি না সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’ কতজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা দেখে বলতে হবে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসামিদের কাছ থেকে কেউ টাকা চেয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। জানার কথাও না।’

ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী সম্প্রতি এই ধরনের অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গত ৯ ডিসেম্বর তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের মামলা বাণিজ্যের কারণে এক এসআইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের মামলা বাণিজ্যে পুলিশও জড়িত। আমার লোক (পুলিশ) যে সব ভালো তা বলব না। আমার কাছে যাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।’

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিলেট রেঞ্জ থেকে ডিএমপিতে বদলি হয়ে আসা শাহিন পারভেজকে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় আদাবর থানায় দায়ের করা একটি মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পেয়ে মামলার এক আসামির কাছে টাকা দাবি করেন তিনি। ভুক্তভোগী বিষয়টি ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে জানালে তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়।

সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

What do you like about this page?

0 / 400

Verified by MonsterInsights