শিল্পাঞ্চলে তীব্র গ্যাসসংকট
শাহেদ আলী ইরশাদ
বছরের পর বছর গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় রপ্তানিমুখী শিল্পসহ অন্যান্য কারখানার উৎপাদন তীব্র সংকটের মুখে পড়েছে। টেক্সটাইল, সিরামিক, তৈরি পোশাকসহ দেশের প্রধান শিল্পের ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টের গ্যাসের চাপ যেখানে ১৫ পিএসআই (পার স্কয়ার ইঞ্চি) থাকার কথা, সেখানে সাধারণত ২ বা ৩ পিএসআই চাপ পাওয়া যাচ্ছে। আবার মাঝেমধ্যে গ্যাসের চাপ শূন্যও হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর এবং ময়মনসিংহের মতো প্রধান শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে দৈনিক প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাসের প্রয়োজন। যেখানে বর্তমানে সরবরাহ আছে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। যার ফলে দিনে সরবরাহ ঘাটতি ১ হাজার এমএমসিএফ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে ১ হাজার ৮০০টি টেক্সটাইল মিল রয়েছে। এর মধ্যে ৭০০ স্পিনিং মিল। গ্যাস সংকটের কারণে ৫০ শতাংশ মিল বন্ধ হয়ে গেছে। এই সুযোগে ভারত থেকে বৈধ-অবৈধভাবে সুতা আমদানি হচ্ছে। আমাদের মিলগুলো পুরোদমে চালু থাকলে আরও ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হতো।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের কারখানা স্থানান্তর হলেও আমাদের হাতছাড়া হচ্ছে। বিগত সরকারের লটুপাটের কারণে এসব কারখানা আমাদের দেশে স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ব্যবসায়ীদের পুঁজি অর্ধেকে নেমে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে যারা অর্থনীতির চালিকাশক্তি, কর্মসংস্থান তৈরি করছেন ব্যাংকগুলো তাদের সহায়তা করছে না। আমরা টাকা পাচ্ছি না। সিরামিক শিল্প সম্পূর্ণভাবে গ্যাসনির্ভর। গ্যাসকে কাঁচামাল হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এ খাতে গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি নেই।
খাত-সংশ্লিষ্টদের মতে, সিরামিক কারখানাগুলোতে গ্যাসের ১৫ পিএসআই চাপ প্রয়োজন কিন্তু তারা ২ বা ৩ পিএসআই পাচ্ছেন, মাঝেমধ্যে শূন্যেও নেমে আসছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মইনুল ইসলাম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তাদের বেশির ভাগ কারখানা উৎপাদন ক্ষমতার ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে, আমাদের প্রতি মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। এমনকি পেট্রোবাংলাও পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। পেট্রোবাংলা তাদের বলেছে, পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি করা হলে অথবা তারা নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে পারলেই পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, গত ৯ বছরে (২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত) সরকার গ্যাসের দাম প্রায় ৩৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে এবং ২০২৩ সালে প্রায় ১৫০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি করেছে এবং নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু সরকার তা রক্ষা করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, শুধু গ্যাস সংকটের কারণে ৫০টিরও বেশি সিরামিক কোম্পানি তাদের পুনঃবিনিয়োগ স্থগিত করেছে, যার মধ্যে পাঁচটি নতুন স্থাপন করা কারখানাও রয়েছে, যারা উৎপাদন শুরু করতে পারেনি।
তৈরি পোশাক খাত মূলত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস ব্যবহার করে। গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে এই শিল্পও বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। চৈতি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সম্মিলিত পরিষদের প্যানেল নেতা মো. আবুল কালাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে পোশাক খাতের উৎপাদন প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে। তা ছাড়া টেক্সটাইল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তৈরি পোশাক খাতও কাঁচামাল পেতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে দেশের শিল্প খাতের প্রধান চারটি শীর্ষ বাণিজ্য সংস্থা- বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএ এবং বিটিটিএলএমইএ যৌথভাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে উৎপাদকরা লিখেছেন, কারখানাগুলো অপর্যাপ্ত গ্যাস চাপ এবং অনিশ্চয়তার ওপর পরিচালিত হচ্ছে এবং উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। গ্যাসের ঘাটতির কারণে শিল্পাঞ্চলে উৎপাদন ৫০-৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে; যা সরবরাহ শৃঙ্খল এবং কারখানার উৎপাদন ব্যাহত করেছে। তৈরি পোশাক খাতে সময়মতো কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, যা সময়মতো সরবরাহ ব্যাহত করছে।