বেলাই বিলে দখলের থাবা

শামীম আহমেদ ও হাসান ইমন
বেলাই বিলকে বলা হয় গাজীপুরের দেশি মাছের ভান্ডার। এ বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন শত শত জেলে। বর্ষায় বন্যা ও জলাবদ্ধতা থেকে গাজীপুর অঞ্চলকে রক্ষায় শত শত বছর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে প্রায় ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিলটি। বেলাই বিলের পানি দিয়ে চাষাবাদ করেন জেলার চার উপজেলার কৃষক। জেলার অসংখ্য নদী ও খালের সঙ্গে যুক্ত থাকা পরিবেশগত দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন বিলটি দখলদারের হিংস্র থাবায় বিলীন হতে চলেছে। উচ্চ আদালত ও সরকারের বিভিন্ন দফতরের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আবাসনের সাইনবোর্ড বসিয়ে রাতের আঁধারে চলছে ভরাট কার্যক্রম। অনুমোদন ছাড়াই ম্যাপ দেখিয়ে হচ্ছে প্লট বিক্রি। এতে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। কাল্পনিক আবাসন প্রকল্পের লেআউট দেখে প্লট কিনে প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা। গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায় টঙ্গী-কালীগঞ্জ মহাসড়কসংলগ্ন পুবাইলে বেলাই বিলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তেপান্তর, নর্থ-সাউথ গ্রুপ ও কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গংয়ের সাইনবোর্ড লাগানো। সড়কের পাশে বিলের কিছু অংশ ভরাট করে তেপান্তরের বড় সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। পাশেই বিলের মধ্যে রাস্তা করে পানির ভিতরে তৈরি হচ্ছে নর্থ-সাউথ গ্রুপের পাকা স্থাপনা। একই জায়গায় ‘কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গং’ লেখা নতুন সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে সম্প্রতি। পুবাইল ব্রিজ থেকে সড়কের পাশ দিয়ে ড্রেজারের পাইপ টেনে আনা হয়েছে ওই এলাকা পর্যন্ত। ইতোমধ্যে বিলের মাঝে অনেকটা এলাকা ভরাট করা হয়েছে। চারদিকে কচুরিপানা ও শাপলা থাকলেও ভরাট অংশে বেড়ে উঠেছে কাশবন। স্থানীয়রা জানান, কাশবন গজিয়ে ওঠা জায়গা কয়েক বছর আগেই ভরাট করা হয়েছে। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রশাসনের লোকজন এসে ড্রেজার বন্ধ করে দেন। কিছু সাইনবোর্ড তুলে ফেলেন। তারা চলে গেলে আবার সাইনবোর্ড বসানো হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি রাতের আঁধারে আবার ভরাট শুরু হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কোম্পানিগুলো এলাকার প্রভাবশালী ও গুন্ডা প্রকৃতির লোকজনকে জমির দালাল নিয়োগ করেছে। তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে কৃষককে জমি বিক্রিতে বাধ্য করছে। বাড়িতে বসেই হচ্ছে জমি রেজিস্ট্রি। নর্থ-সাউথ গ্রুপের সাইনবোর্ডের পাশে কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গং লেখা সাইনবোর্ড কার- জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা রওশন বলেন, কোম্পানির নামে জলাভূমি ভরাটে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই ব্যক্তিমালিকানা সাইনবোর্ড লাগিয়ে ভরাট করছে। ইউসুফ আলী নর্থ-সাউথ গ্রুপেরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এদিকে আবাসন প্রকল্পের লেআউট অনুযায়ী শুধু নর্থ-সাউথ গ্রুপেরই দখলে আছে বেলাই বিলের ৩ হাজার বিঘার বেশি জমি। লেআউট অনুযায়ী প্রায় একই পরিমাণ জমি দখলে রয়েছে তেপান্তরের। তবে স্থানীয়রা জানান, সাইনবোর্ড বসানো অধিকাংশ জায়গা এখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন। প্রতি সাইনবোর্ড বসানের জন্য মাসে জমির মালিককে দেওয়া হয় ১ হাজার টাকা। শুধু ম্যাপ বানিয়ে চার বছরের বেশি সময় ধরে প্লট বিক্রি করছে কোম্পানিগুলো।

এদিকে প্রকল্প এলাকায় তেপান্তরের প্রকল্প সুপারভাইজার টুটুল বলেন, তাদের সামনের দিকের অধিকাংশ প্লট বিক্রি হয়ে গেছে। দাম ও অন্যান্য বিষয় জানতে ঢাকায় হেড অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। তার সিনিয়র কর্মকর্তার নম্বর চাইলে নিজের ফোন দিয়ে প্রজেক্ট ম্যানেজার মামুনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। মামুন বলেন, ‘প্রকল্পের অনুমোদন হয়নি। তাই প্লট বিক্রি হচ্ছে না।’ তবে তেপান্তরের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে ২০১৯ সাল থেকেই প্লট বিক্রির তথ্য রয়েছে।
এদিকে নর্থ-সাউথের কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করলে বলা হয়, চাহিদার কারণে তাদের প্লটের দাম দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে প্রতি কাঠা ২ থেকে ৬ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পুরো পেমেন্ট করলে তিন দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হবে এবং রেজিস্ট্রেশন ফি কোম্পানি বহন করবে। ২০২৬ সালের মধ্যে প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হবে। বেলাই বিলে আবাসনের অনুমতির ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের গাজীপুর জেলা অফিসের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেলাই বিলে কোনো আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। নর্থ-সাউথ গ্রুপ, তেপান্তর- এ প্রকল্পগুলো ভিজিট করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে সব তথ্যসহ কাগজপত্র পাঠিয়েছি। বিলগুলো যাতে আবার আগের অবস্থায় ফিরে পাওয়া যায় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ড্রেজার বন্ধ করার জন্য স্থানীয় এসি ল্যান্ডের (সহকারী কমিশনার, ভূমি) তৎপরতা লাগবে। তিনি ড্রেজার বন্ধ করবেন। প্রয়োজনে আমাদের ডাকবেন। পুলিশ পাহারা বসাবেন।’ গাজীপুর সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাফে মোহাম্মদ ছড়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০১০ সালের জলাশয় আইন অনুযায়ী বিভাগীয়, জেলা ও পৌর শহরের জলাশয় ভরাট করা যাবে না। খালের পাশে বিলের জায়গাগুলো ব্যক্তিগত হলেও ভরাট করা যাবে না। এ ছাড়া হাই কোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক বেলাই বিল ও আশপাশের জলাশয়গুলোয় বালু ভরাট, অবৈধ দখল ও সাইনবোর্ড টানানো যাবে না। এরই মধ্যে আমরা নোটিস করে দিয়েছি। শনিবার কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ আমি সরেজমিনে ঘুরে এসেছি। কয়েক জায়গায় বালু ভরাটের পাইপ খুলে ফেলেছি। তবে রাস্তার পাশের পাইপগুলো মোটা হওয়ায় খোলা যায়নি। নোটিসের পরও যদি তারা অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকে তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেলাই বিলের কিছু অংশ কালীগঞ্জের বক্তারপুর ইউনিয়নে। বেশির ভাগ অংশ সদর উপজেলার বাড়িয়ার ইউনিয়নে। হাই কোর্টের নির্দেশে আমরা অভিযান চালিয়ে ড্রেজারের পাইপ খুলে দিয়েছিলাম। সাইনবোর্ড তুলে দিয়েছিলাম। এরপর দীর্ঘদিন ভরাট বন্ধ ছিল। তিন-চার দিন আগে আবার শুরু হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

জানা গেছে, সরকারের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের কাজ শুরু হলে বাড়তে থাকে এর আশপাশ এলাকার গুরুত্ব ও জমির দাম। ঢাকা ও গাজীপুর জুড়ে বিস্তৃত পূর্বাচল সামনে রেখে আশপাশে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক আবাসন প্রকল্প। শুরু হয় খাল-বিল দখলের পাঁয়তারা। সেই দখলে পড়ে যায় গাজীপুরের কালীগঞ্জ ও সদর উপজেলাজুড়ে থাকা বেলাই বিলটিও। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে ঢাকার পূর্বাচল হাউজিং প্রকল্পের পাশে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার ২২টি আবাসন কোম্পানি কর্তৃক জলাশয়, খাল-বিল ও নিচু জমি অবৈধভাবে ভরাট কার্যক্রমের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন হাই কোর্ট। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে থামেনি খাল-বিল দখল ও ভরাট। এ ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের নেওয়া পূর্বাচল প্রকল্প বাঁচাতে হলে বেলাই বিলসহ আশপাশের জলাভূমিগুলো রক্ষা করতে হবে। এগুলো ভরাট হয়ে গেলে পূর্বাচল বন্যায় আক্রান্ত হবে। আদালত ভরাটে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছেন। সেটা বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমরা আদালত অবমাননা মামলাও করেছি। সেখানে জেলা প্রশাসকরা চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সাইনবোর্ড ভেঙে দিয়েছেন। তার পরও ইদানীং ভরাট কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আবার আদালত অবমাননা মামলা করেছি। আগামী রবিবার মামলার শুনানি।’

এদিকে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) আওতায় গাজীপুরের বেলাই বিলও রয়েছে। ড্যাপে বিলটি জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেলাই বিলটি ড্যাপে জলাশয় হিসেবে রয়েছে। যেহেতু জলাশয়, তাই কেউ ভরাট করতে পারবে না। ব্যক্তিগত জমি হলেও ভরাটের সুযোগ নেই।’

প্রাকৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিল : চিলাই, পারুলী, তুরাগ ও বালু নদ, মোগর খাল, হায়দরাবাদ খাল, কালিয়াখালী খালসহ ১০-১২টি নদনদী ও খাল গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে বেলাই বিলে। এসব নদী-খাল আবার যুক্ত হয়েছে শীতলক্ষ্যায়। গাজীপুর সদর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া, শ্রীপুর- এ চার উপজেলার সীমান্তজুড়ে বিলটির অবস্থান। বিলটির মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট ছোট আরও অনেক খাল। বেলাই বিলের পানিতে কৃষিকাজ চলে চার উপজেলায়। গাজীপুরে স্বাদুপানির মাছের বড় অংশ আসে এ বিল থেকে। এ বিলের ওপর নির্ভরশীল শত শত জেলে পরিবার। বোরো মৌসুমে সোনালি ধানে ছেয়ে যায় বিলটি। বর্ষায় বিপুল পরিমাণ পানি ধারণ করে ওই অঞ্চলকে বন্যার কবল থেকে রক্ষায় অবদান রাখে বেলাই বিল। এ বিলের শাপলা বিক্রি করে ও বিলের নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে অনেক পরিবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights