বন্ধুহীন রাজার বংশহীন সিংহাসন!

রাজনীতি করার জন্য উত্তম বংশপরিচয় দরকার এবং বংশীয় লোকজন যদি রাজনীতিতে সচেতন না হয় এবং বংশের প্রধান ব্যক্তিকে সমর্থন না করে তবে কারও পক্ষেই রাজনীতিতে সফল হওয়া সম্ভব নয়। বংশ বা গোত্র কীভাবে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং কীভাবে গোত্রীয় রাজনীতি থেকে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ ইতিহাসে রয়েছে। রাজনীতির সর্বকালের সেরা দার্শনিক ইবনে খালদুন এবং তাঁর অমর সৃষ্টি যারা পড়েছেন তারা উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমী, মুর, অটোমান দাস বংশ, লোদি বংশ, পাল বংশ ও মৌর্য বংশ থেকে শুরু করে মুঘল বংশের সফলতা কিংবা ব্যর্থতার কারণগুলো মুখস্থ বলে দিতে পারেন।

আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু বাংলাদেশের পারিবারিক রাজনীতির ব্যর্থতা। এ ক্ষেত্রে আমরা বিএনপি-আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দুরবস্থা নিয়ে ইতিহাসের আলোকে এবং গাণিতিক নিয়ম অনুসরণ করে আলোচনা করব। আলোচনার সুবিধার্থে শিরোনাম নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক। প্রথমত, রাজার উত্তম বন্ধু থাকা প্রয়োজন। বন্ধুহীন রাজা সফল হতে পারে না। আবার বজ্জাত, চরিত্রহীন, লুটেরা, ডাকাত প্রকৃতির লোকজন যদি রাজার বন্ধু হয় তবে রাজা পুরো রাষ্ট্রকে চোর-ডাকাতের অভয়ারণ্যে পরিণত করে। রাজার বন্ধুদের কারণে বাঈজি মহল, পতিতালয়, জুয়ার আসর, কখনো কখনো রাজদরবার কিংবা বিচারালয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এখন প্রশ্ন হলো, রাজা কীভাবে বন্ধু নির্বাচন করে। এ ক্ষেত্রে রাজার অভ্যাস, শিক্ষাদীক্ষা-পারিবারিক অনুশাসন এবং তার শরীরের রক্ত ও মাংসে ভালো ও মন্দ কাজের যে বীজ লুকায়িত থাকে তার ওপর ভিত্তি করে রাজার অভ্যাস, চিন্তা-আচরণ, মনমানসিকতা গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে রাজার যদি উত্তম অভিভাবক, উত্তম শিক্ষক এবং বংশীয় ক্ষমতাধর লোকজন থাকে তবে রাজার রাজকার্যে কুকর্ম ঢুকতে পারে না। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন থাকে নোংরামিতে পরিপূর্ণ। অন্যদিকে রাজার ব্যক্তিগত যোগ্যতা যদি অতি উঁচু স্তরের হয় এবং যদি বংশীয় লোকজন তার চারপাশে না থাকে সে ক্ষেত্রে সে দেশবিদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষকে নিজের বন্ধু বানিয়ে নেয় এবং বন্ধুদের নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে একটির পর একটি মাইলফলক স্থাপন করে- যেমন সম্রাট শেরশাহ।

আপনি যদি মন্দ রাজাদের চরিত্র, অভ্যাস এবং কুকর্ম বিশ্লেষণ করতে চান তবে রোমান সম্রাট নিরোর জীবনী অধ্যয়ন করতে পারেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর সর্বকালের সেরাবিএনপি-আওয়ামী লীগ একটি পরিবারে। পৃথিবীর মহাকালের রাজাদের রাজা বলে স্বীকৃত জুলিয়াস সিজারের বংশধারার ধারক ছিলেন তিনি। তাঁর শিক্ষক সেনেফাকে বলা হয় সর্বকালের সেরা দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ। তাঁর জন্মদাতা পিতা ডমিটিটাস ছিলেন জুলিও ক্লডিয়ান রাজবংশের অন্যতম ধারক। তাঁর মা এগ্রোপিনা ছিলেন একই রাজপরিবার অর্থাৎ জুলিয়াস সিজার ও অগাস্টাস সিজার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের অন্যতম রাজকন্যা। এগ্রোপিনা যখন তাঁর নিজ বংশের রাজরক্তের ধারক স্বামী ডমিটিটাসকে ত্যাগ করে শিশুপুত্র নিরোকে নিয়ে অগাস্টাস নামক একজন সামরিক কর্তার ছেলেকে বিয়ে করেন ঠিক তখন থেকেই সমস্যা শুরু হয়।

নিরোর মা এগ্রোপিনা ছিলেন দুশ্চরিত্রা, নির্মম, নিষ্ঠুর এবং ক্ষমতালোভী। নিজের রাজরক্ত, বংশপরিচয়, কুটবুদ্ধি, জরায়ু ও যোনিকে ব্যবহার করে তিনি রোমান সিংহাসনের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য করেননি এমন কুকর্ম নেই। কুখ্যাত সম্রাট কালিগুলাকে হত্যার জন্য নীলনকশা এবং সিংহাসনে নিজের দ্বিতীয় স্বামী ক্লডিয়াসকে বসানোর জন্য এগ্রোপিনা রোমে রক্তের বন্যা বইয়ে দেন। ক্লডিয়াস শারীরিকভাবে খোঁড়া ছিলেন এবং কানেও কম শুনতেন। ফলে রাজবংশের নিয়ম অনুযায়ী তিনি সেনাবাহিনীতে ঢুকতে পারেননি। এ অবস্থায় সিংহাসনে তাঁর উত্তরাধিকারের দাবিটি ভাতিজা কালিগুলাকে দিয়ে দেন এবং তিনি রোম ছেড়ে সুদূর গল এলাকায় বসবাস শুরু করেন।

এগ্রোপিনার সঙ্গে সম্রাট ক্লডিয়াসের সম্পর্ক ছিল চাচা-ভাতিজির। এগ্রোপিনার চক্রান্তে যখন ৪১ খ্রিস্টাব্দে কালিগুলা নিহত হন তখন উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল-অসহায় ভেবে চাচা ক্লডিয়াসকে সিংহাসনে বসানোর জন্য তিনি পর্দার আড়ালের কলকাঠি নাড়তে থাকেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর সম্রাট ক্ল¬ডিয়াস শারীরিক ত্রুটি সত্ত্বেও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে অসম্ভব ভালো করতে থাকেন। তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু দার্শনিক সেনেকার সহায়তায় তিনি জ্ঞানবিজ্ঞান, যুদ্ধ জয়, রাজ শাসনে এক অনন্য নজির স্থাপন করেন এবং ভালো বন্ধু ও ভালো কর্মের কারণে এগ্রোপিনার কর্তৃত্ব এবং চক্রান্ত হুমকির মুখে পড়ে। এগ্রোপিনার কবল থেকে নিজেকে এবং সিংহাসনকে রক্ষার জন্য তিনি তাঁর খোঁড়া পা নিয়ে যুদ্ধ জয়ে বের হয়ে পড়েন এবং ৪৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন জয় করে রোমে ফেরেন।

সম্রাট ক্ল¬ডিয়াসের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছে এবং তাঁর তিন স্ত্রীর মধ্যে দুজন ছিলেন রাজপরিবারের সদস্য। যাঁরা এগ্রোপিনার উচ্চাভিলাষের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান। এ অবস্থায় এগ্রোপিনা সম্রাটকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ৪৯ খ্রিস্টাব্দে বিয়ে করেন এবং ছলেবলে-কৌশলে তাঁর আগের স্বামীর ঔরসজাত বালক নিরোকে ভবিষ্যৎ সম্রাট হিসেবে মনোনীত করতে বাধ্য করেন। এরপর সম্রাট ক্লডিয়াসকে হত্যা করে নিরোকে সিংহাসনে বসিয়ে পর্দার আড়াল থেকে পুরো সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। ৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ তারিখে সম্রাট নিরো তাঁর মাকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।

সম্রাট নিরোর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁর রাজরক্ত মায়ের যৌনাচার দ্বারা দূষিত হয়েছে। তাঁর মায়ের পেটে গর্ভধারণ এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে ও পরে দুশ্চরিত্রা মায়ের বিকৃত যৌনাচারের কারণে তাঁর শারীরিক গঠন তথা জন্মকে ত্রুটিযুক্ত যেটিকে ক্রস ব্রিডিং বা সংকর প্রজাতি বলা হয়। নিরোর হাতেই জুলিও ক্ল¬ডিয়াস সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং নিরোর ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে সারা দুনিয়া পারিবারিক রাজনীতি, রাজকীয় উত্তরাধিকারের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষাদীক্ষার বিষয়ে যারা সচেতন হয়েছে, তারাই পৃথিবীতে একটি অনন্যসাধারণ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

রাজ অন্তঃপুর, সম্রাজ্ঞীদের জীবন ও রাজার চরিত্র যত বেশি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে ততই সেখানে যোগ্য উত্তরাধিকারী তৈরি হয়েছে এবং একেকটি পরিবার শত শত বছর ধরে রাজ্য শাসন করতে পেরেছে। বিশুদ্ধ পরিবেশে রাজপুত্রের জন্ম, উপযুক্ত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের জন্য যেসব রাজবংশ যত বেশি যত্নবান ছিল সেসব রাজবংশ থেকেই খলিফা প্রথম ওলিদ, খলিফা মালেক ইবনে মারোয়ান, খলিফা আল মনসুর, হারুন, মামুন অথবা সুলতান সুলেমানের মতো রাষ্ট্রনায়ক তৈরি হয়েছেন।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি। আমাদের দেশে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা ও সফলতার সঙ্গে সম্রাট নিরোর জন্ম ও ব্যর্থতার কোনো তুলনা না করার জন্য সম্মানিত পাঠকদের দার্শনিক ইবনে খালদুনের আল মুকাদিমা গ্রন্থের গোত্রপ্রীতি অধ্যায়ের আলোকে আমাদের দেশের পরিবারতন্ত্র বিশ্লেষণের অনুরোধ জানাচ্ছি। আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধুর বংশ এবং আত্মীয়-পরিজনরা তাঁর জমানায় রাজনীতিতে সবেমাত্র প্রবেশ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর গোত্রের লোকেরা রাজনীতি করুক। এর বাইরে তাঁর বন্ধুদের সংখ্যা ছিল অনেক যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন দক্ষ-অভিজ্ঞ-পরীক্ষিত। ফলে তাঁর শাসনামলের পর্বতসম ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাঁর দলটি একটি পারিবারিক দলে পরিণত হয় এবং এই দলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী পারিবারিকভাবে বংশপরম্পরায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি ভারতের গান্ধী পরিবার, পাকিস্তানের ভুট্টো বা নওয়াজ শরিফ পরিবারের মতো শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত হতো তাহলে শেখ হাসিনাকে পালাতে হতো না।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান গোত্রপ্রীতির বিষয়টি পছন্দ করতেন না। তাঁর বন্ধুবান্ধবও ছিল না। এমনকি পরিবার গঠনের বিষয়ে তিনি রাজনৈতিক দর্শনশাস্ত্র চর্চা করার সময় ও সুযোগ পাননি। তবে তাঁর শরীর রক্ত, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ এবং চরিত্র অনেকটা রোমান সম্রাট মার্কাস আলমাস অথবা ভারত সম্রাট শেরশাহের মতো ছিল। ফলে তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি রাজনৈতিক দর্শন এবং সেই দর্শনের আলোকে একটি দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর দল বহুবার ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু শত চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের মতো গোত্রপ্রিয় এবং পারিবারিক প্রাধান্যবিশিষ্ট রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারেনি।

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন জিয়াউর রহমানকে অনুসরণ করার জন্য। কিন্তু শারীরিক গঠন, আচার-আচরণ ও চরিত্র জিয়ার মতো না হওয়ার কারণে কাক্সিক্ষত সফলতা আসেনি। আমরা আজকের আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনীতির রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনপ্রক্রিয়া এবং কর্মকাণ্ড কোনো অবস্থাতেই ইউরোপ-আমেরিকার মতো হবে না। গোত্রপ্রীতি, আবহাওয়া, খাদ্য ও অভ্যাসের কারণে বড়জোর ভারত-পাকিস্তানের মতো হবে। দলের প্রধানের ওপর যদি সৎ, যোগ্য পারিবারিক সদস্যদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ থাকে তবে লেখাপড়া কম হলেও নেতার সফলতা নিশ্চিত। অন্যথায় পতন, দুর্ভোগ, দুর্দশা অনিবার্য। নেতার পরিবারে যদি যোগ্য লোক না থাকে তবে নেতা যদি ভালো বন্ধু-যোগ্য সহকারী-দক্ষ কর্মী এবং বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ও শিক্ষক কাম দার্শনিকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন তবে তাঁর চরিত্র যা-ই হোক না কেন তিনি সফল হবেন। আর নেতা যদি মন্দ লোকের কবলে পড়েন তবে তাঁর পতন নিশ্চিত। অন্যদিকে তিনি যদি নিজে মন্দ হন এবং মন্দ লোকদের মিলনমেলা গড়ে তোলেন তবে প্রতিটি জনপদ জ্বলন্ত জাহান্নামে পরিণত হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights