মুছে গেছে কুয়াশায় ফেরি বিপর্যয়ের গল্প, পদ্মা সেতু কমিয়েছে ভোগান্তি

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার হিসাবে পরিচিত রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট। এক সময় ঢাকার সাথে যোগাযোগের সবেচেয়ে ব্যস্ততম নৌরুট হিসাবে পরিচিত ছিলে এটি।

শীতকালে কুয়াশায় ফেরি বন্ধে দীর্ঘ সময় যাত্রী ও চালকদের ভোগান্তি পোহাতে হতো। ঘন কুয়াশায় ফেরি বন্ধ থাকার কারণে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে লেগে থাকতো যানজট। গোয়ালন্দ মোড় থেকে ফেরিঘাট পর্যন্ত মহাসড়কটি সচল রাখতে গোয়ালন্দ মোড়ে যানবাহন আটকে দিতো পুলিশ। গোয়ালন্দ মোড় থেকে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের ৬ কিলোমিটার যানজট ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। যাত্রীবাহী বাসগুলোকে ফেরিপার হতে সময় লাগতো ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে অপেক্ষায় থাকতে হতো তিনদিন পর্যন্ত। চলতি বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হয়। পদ্মা সেতু চালুর পর সেই ভোগান্তি দূর হয়েছে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে কুয়াশায় মধ্যরাত থেকে ফেরি বন্ধ থাকছে। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শনিবার সকাল ১১টা পর্যন্ত দুর্ঘটনা এড়াতে ফেরি বন্ধ রাখে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ সাড়ে ১০ঘণ্টা ফেরি চলাচন্ধ বন্ধ থাকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে। দীর্ঘ সময় ফেরি চলাচল বন্ধের সেই প্রভাব পড়েনি দৌলতদিয়া প্রান্তে। নেই সেই চিরচেনা ভোগান্তি। ফেরিঘাটের পল্টুনে শোনা যায়নি অ্যাম্বুলেন্সের হুটারের শব্দ। রোগীর স্বজনদের ঢাকা যাওয়ার অসহায় আর্তনাদ। গত কয়েকদিন কুয়াশায় ফেরি বন্ধ থাকলেও যানবাহনের কোন জট তৈরি হয়নি দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায়। ফেরি বন্ধের সংবাদ জানার পর পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা যাচ্ছেন যাত্রীরা।
রাজবাড়ীর অ্যম্বুলেন্স চালক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, কুয়াশার সময় রাজবাড়ী থেকে অনেক রোগী ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করতো। সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দিতেন চিকিৎসকরা। আমার অ্যাম্বুলেন্সে রোগীর স্বজনদের আর্তনাদ শুনেছি শুধু পদ্মা পাড়ি দেওয়ার জন্য। হয়তো দুই-একজন রোগী ফেরিঘাটে পারের অপেক্ষায় থেকে মারাও গিয়েছেন। এখন আর আমাদের ভোগান্তি নেই। নেই রোগীর স্বজনদের ফেরি পার হওয়ার সেই আর্তনাদ।

বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক ছিলেন আবু আব্দুল্লাহ রনি। তিনি বর্তমানে আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটের ফেরি সার্ভিসের ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করছেন। পদ্মা সেতু চালু পূর্ববর্তী-পরবর্তী সময় নিয়ে কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, শীতকালে আমারা রাতে ঘুমাতে পারতাম না। প্রচণ্ড যানবাহনের চাপ থাকতো। শত শত গাড়িকে ফেরি পারের অপেক্ষায় রাখতে হতো। আমাদের তাকিয়ে থাকতে হতো সূর্যের দিকে। বর্তমানে সেই চিত্র আর নেই। এক পদ্মা সেতুই যাত্রী ও চালকদের সব দুর্ভোগ রুখে দিয়েছে।

কুয়াশায় ফেরি বন্ধের সংবাদ সরাসরি দেখাতে হতো নিউজ চ্যানেলে কাজ করা রাজবাড়ীর সংবাদকর্মীদের। বেসরকারি টেলিভিশনের রাজবাড়ী প্রতিনিধি সুমন বিশ্বাস বলেন, ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচল বন্ধ হলে কার্যত ঢাকার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতাযাত বন্ধ হয়ে যেত। সেটি এখন আর নেই। ৬ থেকে ১০ ঘন্টা ফেরি বন্ধে দৌলতদিয়া প্রান্তে ১০ কিলোমিটার যানজট থাকতো। গত কয়েকদিন ধরেই কুয়াশায় ফেরি বন্ধের সংবাদ সংগ্রহ করছি। সব মিলিয়ে শতাধিক গাড়ি অপেক্ষায় ছিল। কুয়াশার পর ফেরি চলাচল শুরু হলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সবগুলো গাড়ি পার করা সম্ভব হচ্ছে। তিনি বলেন, কুয়াশায় ফেরি চলাচল বন্ধ হলে সব যানবাহনের পদ্মা সেতু হয়ে রুট পারমিট দিয়ে দেওয়া উচিত।

পদ্মা সেতুর আগের বছর দৌলতদিয়া ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেছেন রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার এম এম শাকিলুজ্জামান। পদ্মা সেতুর চালু হওয়ার পর তিনি কাজ করছেন। তিনি বলেন, কুয়াশার সময় জনগণের ভোগান্তি হতো এটা সত্য। তবে আমরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের মধ্য দিয়ে কাজ করেছি। আমরা ভিআইপি প্রথা বাতিল করেছিলাম। অনেক নারী ও শিশুদের আমাদের দৌলতদিয়া পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে আশ্রয় দিয়েছি। অনেক সময় আমাদের পুলিশ সদস্যরা খাবার পানি সরবরাহ করেছেন। এখন আর সেই ভোগান্তি নেই। ভোগান্তির সেই স্মৃতি রয়ে গেছে।… কুয়াশার কারণে এখন আর ঢাকার সাথে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতাযাত বন্ধ হয়না। ফেরিঘাটের সেই বিপর্যয় রুখে দিয়েছে পদ্মা সেতু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights