আকাশপথে মাদকের ঢল
সাখাওয়াত কাওসার
রোহিঙ্গারাও প্লেনে করে আসছে কক্সবাজার থেকে। বহন করে নিয়ে আসছে ইয়াবা। বিমানবন্দর এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থাকে পুঁজি করেই আকাশপথের দিকে ঝুঁকছে তারা। ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এটা চলতেই থাকবে
জল-স্থলের পর এবার আকাশপথকে নিরাপদ ভাবছে মাদক কারবারিরা। দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়ারা বাংলাদেশকে মাদকের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। কয়েক বছর ধরে দেশের উচ্চবিত্তের বখে যাওয়া সন্তানদের জন্য নতুন নতুন ক্রেজি ড্রাগস আকাশপথে উড়িয়ে নিয়ে আসছে মাদক কারবারিরা। এখন দেশীয় মাদক কারবারিদের পছন্দের তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে আকাশপথ। অন্যদিকে, উদ্বেগের বিষয় হলো রোহিঙ্গারাও প্লেনে করে আসছে কক্সবাজার থেকে। বহন করে নিয়ে আসছে ইয়াবা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দর এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থাকে পুঁজি করেই আকাশপথের দিকে ঝুঁকছে তারা। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এটা চলতেই থাকবে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা করে যচ্ছি নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও কঠোর করতে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ-সংক্রান্তে আমাদের পরামর্শ এবং তথ্যের আদানপ্রদান হয়। কক্সবাজার এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা ইস্যু-সংক্রান্তে তথ্যের আদানপ্রদান হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। সমস্যা সমাধান করতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ডিএনসিসহ একাধিক সূত্র বলছে, চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকার মাদক কারবারিরা মাদক পরিবহনের জন্য কক্সবাজার এয়ারপোর্টকে ব্যবহার করে আসছে। কারণ ওই এয়ারপোর্টের নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেক ঢিলেঢালা। সহজেই নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়া যায়। বিভিন্ন সময় বিমানবন্দর এবং এয়ারলাইনসে কর্মরত ব্যক্তিদের নানা কৌশলে ম্যানেজ করে নির্বিঘ্ন করা হয় মাদক পরিবহন।
ডিএনসির পরিচালক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক তানভীর মমতাজ বলেন, গোয়েন্দা তথ্য না পেলে তো অভিযান করা যায় না। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করে যাচ্ছি। সফলতাও আসছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, এখন দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গারাও প্লেনে করে আসছে। সঙ্গে ছিল ৩ হাজার ইয়াবা। এনআইডি ছাড়া কীভাবে তারা প্লেনে উঠল? এ বিষয়টি উল্লেখ করে এবং সহায়তা চেয়ে আমরা বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ- বেবিচককে চিঠি দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, অভিযানের জন্য আমরা ডগ স্কোয়াড, এপিবিএন এবং সিএমপির সহায়তা চেয়েছি। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল থেকে ৮ হাজার পিস ইয়াবাসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিমানবন্দর সার্কেলের পরিদর্শক জিল্লুর রহমান অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- নঈম উদ্দীন (৩৪) ও আজাদুল ইসলাম অভি (১৮)। এদের দুজনই চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার বাসিন্দা। অভি একটি কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নঈম পেশায় গাড়িচালক। প্রতি পিস ১০ টাকা হিসেবে তারা ইয়াবা বহন করছিল। চট্টগ্রামের মাদক কারবারিদের পরামর্শেই তারা কক্সবাজারে গিয়েছিল। সবকিছুর বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল তারা।
ডিএনসির বিমানবন্দর সার্কেলের পরিদর্শক জিল্লুর রহমান বলেন, অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের ডাচ-বাংলা এটিএম বুথের সামনে কক্সবাজার থেকে আসা যাত্রী নঈম উদ্দীন ও অভিকে তল্লাশি করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৪ হাজার করে মোট ৮ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় থানায় তাদের নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, ক্যারিয়ার দুজনকে কোনো তথ্যই দেয়নি প্রেরক। শুধু বলেছে তাদের ছবি দেওয়া হয়েছে প্রাপকের কাছে। তাদের চিনে নেওয়া হবে।
জানা গেছে, গত ৯ দিনে রাজধানীতে ইয়াবার চারটি চালান পরপর ধরা পড়েছে। এর মধ্যে তিনটি চালান এসেছে আকাশপথে। মাদক কারবারিরা বর্তমানে আকাশ এবং ট্রেনে করে মাদক পরিবহনকে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে। মূলত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ফাঁকি দিতে মাদক কারবারিরা একেক সময় একেক রুট ও কৌশল বেছে নেয়। গত ১৪ অক্টোবর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে কফির নূর নামে এক রোহিঙ্গা ও তার ভাগনে মো. জুবাইরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা কক্সবাজারের টেকনাফে থাকে। সেখানকার মাদক কারবারিদের বাহক হিসেবে কাজ করে। ইয়াবার চালান নিয়ে তারা কক্সবাজার থেকে বিমানে ঢাকায় আসে। এখানে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে এক কারবারির কাছে চালানটি পৌঁছে দেওয়াই তাদের কাজ। ৬ হাজার পিস ইয়াবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা দুজন ৩০ হাজার করে মোট ৬০ হাজার টাকা পায়। বিমান ভাড়াসহ যাতায়াতের যাবতীয় খরচ টেকনাফের ইয়াবা কারবারির। প্রতি মাসে তারা তিন থেকে চারবার ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় আসত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়। সেই হিসাবে মাসে তাদের আয় দেড় লাখ টাকার বেশি। ঠিক এক দিন পরই ১৬ অক্টোবর বিমানবন্দর এলাকায় আলী জওহার ও ইভা আক্তার ইতি ওরফে জমিলা দম্পতি ১ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়। স্বামী জওহারের বাড়ি টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নে। সে শ্বশুরবাড়ি গাজীপুরে বেড়াতে আসার নামে সস্ত্রীক ইয়াবার চালান নিয়ে আসত। সর্বশেষ ১৭ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডার নতুন বাজার এলাকা থেকে বাবা-ছেলেসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। তারা হলো- হ্নীলা ইউনিয়নের বাসিন্দা রোহিঙ্গা তুহাইল আহম্মদ, তার ছেলে মোহাম্মদ শোয়াইব ও মোহাম্মদ আহাম্মদ। তাদের কাছে পলিথিনের প্যাকেটে ৩ হাজার পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। ঢাকার সঙ্গে কক্সবাজারের ট্রেন যোগাযোগ চালু হওয়ার পর এই রুট ব্যবহার করেও শুরু হয়েছে ইয়াবার কারবার। যাত্রীবেশে ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে কারবারিরা। তবে নিরাপত্তাঝুঁকি এড়াতে কমলাপুর এবং বিমানবন্দরের আগের কোনো স্টেশনে নেমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পোর্টেবল এক্সরে সুবিধা অতিদ্রুত নিশ্চিত করা উচিত ডিএনসিকে। একই সঙ্গে চেকিং পয়েন্ট এবং বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে ডিএনসি সদস্যদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা উচিত।