ইউক্রেন যুদ্ধ : মিথ্যা অভিযোগে রাশিয়ার কারাগারে বন্দী বৃদ্ধ আমেরিকান শিক্ষক!

অনলাইন ডেস্ক
স্টিফেন হাবার্ড অক্টোবর ২০২৪ সালে আদালতের শুনানির সময় একটি কাঁচের খাঁচায় অপেক্ষা করছিলেন। ছবি: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

স্টিফেন জেমস হাবার্ড। যিনি একজন আমেরিকান শিক্ষক যাঁর জীবন কেটেছে যাযাবরের মতো। প্রথমে জাপান, তারপর সাইপ্রাস, সবশেষে ইউক্রেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তাঁকে এনে দিয়েছে বন্দীত্ব, নির্যাতন আর রাশিয়ার কারাগারে নিঃসঙ্গ জীবন। এই সপ্তাহেই তিনি ৭৩ বছরে পা দেবেন।

মিশিগানের এক ছোট শহরে বেড়ে ওঠা জেমস হাবার্ড একাকী জীবন যাপন করতেন। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সময় তিনি পূর্ব ইউক্রেনের ইজিয়াম শহরে ছিলেন। রাশিয়ানরা তাঁকে বন্দী করে ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধ করার মিথ্যা অভিযোগ আনে। এরপর তাঁকে বিভিন্ন রাশিয়ান কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। অবশেষে মস্কোর আদালত তাঁকে প্রায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়।

তাঁর এই দুর্দশার কথা খুব কম মানুষই জানেন। সম্প্রতি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে যে হাবার্ড কে “অন্যায়ভাবে আটক” করা হয়েছে।

হাবার্ড এর বোন এবং তাঁর সাথে কারাবন্দী থাকা ইউক্রেনের তিনজন প্রাক্তন যুদ্ধবন্দী জানিয়েছেন যে তিনি ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধ করেননি। তাঁদের মতে, রাশিয়ান কারাগারে তিনি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বারবার মারধর, কুকুর দিয়ে ভয় দেখানো, দিনের পর দিন দাঁড় করিয়ে রাখা, এমনকি এক মাসেরও বেশি সময় ধরে তাঁকে নগ্ন করে রাখা হয়েছিল।

ইগর শিশকো নামে এক কয়েদী জানান, “তাঁরা আমাদের গোড়ালিতে মারত এবং স্প্লিটের দিকে ঠেলে দিত, যাতে আমাদের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যেত। স্টিফেনের অবস্থাও একই ছিল, বরং আরও খারাপ, কারণ তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান। তারা চিৎকার করে বলত, ‘আমরা জানি তুমি একজন আমেরিকান। তুমি এখানে মৃত!’ ”

যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকানদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর অভিযোগ এনেছে। হাবার্ডসহ ১৩ জন আমেরিকান বর্তমানে রাশিয়ার কারাগারে বন্দী আছেন, যাদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বয়স্ক। ইউক্রেন থেকে বন্দী করে রাশিয়ায় নিয়ে আসার পর তিনিই একমাত্র আমেরিকান যিনি সেখানে বন্দী আছেন।

হাবার্ড এর পরিবার তাঁর কারাগারের সন্ধান করতে পারছে না। রাশিয়ান বিচারক তাঁর মামলার ফাইল গোপন রেখেছেন। মার্কিন দূতাবাসও তাঁকে দেখার অনুমতি পায়নি। হাবার্ড এর বোন প্যাট্রিসিয়া ফক্স জানান, “এটা খুবই হতাশাজনক। এখন তারা তাঁর কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, এমনকি তাঁর চশমাও।”

একাকী জীবন যাপন করা হাবার্ড এর গোপনীয়তা খুব প্রিয় ছিল। তিনি ইমেল বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতেন না। সরকারের উপর তাঁর সন্দেহ ছিল। জীবনের নানা সময়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন, খুঁজেছেন নিজের ঠিকানা। একসময় জাপানি এক মহিলাকে বিয়ে করে সেখানে বসবাস করেছেন, পরে তাঁর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর ইউক্রেনীয় ইননার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ইজিয়ামে চলে আসেন।

যুদ্ধের সময় তিনি সম্ভবত ইননার থেকে আলাদা ছিলেন। রাশিয়ান আক্রমণের সময় তিনি একা ছিলেন। রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ জানায় যে হাবার্ড নাকি ইউক্রেনের আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা ইউনিটে যোগ দিয়েছিলেন এবং প্রতি মাসে ১০০০ ডলার পেতেন। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এই তথ্য অস্বীকার করেন। তাদের মতে, সেখানে কোনো বয়স্ক মানুষ ছিল না। শিশকো জানান, হাবার্ড পালানোর সময় একটি চেকপয়েন্টে ধরা পড়েন।

অন্যান্য যুদ্ধবন্দীরা জানান, Hubbard কে রাশিয়ানরা দুটি ইংরেজি বই দিয়েছিল – “The Egg and I” এবং “The Lovely Bones”। তিনি সেগুলো বারবার পড়তেন। তাঁর সাথে থাকা বন্দীরা হাবার্ড এর জীবনের গল্প শুনেছেন। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভ্রমণ, ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চে যোগদান, জাপানি স্ত্রী সুমি এবং ছেলে হিসাশি, ইননার সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা তিনি প্রায়ই বলতেন।

২০২২ সালের জুলাই মাসে হাবার্ড কে অন্য কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি অন্য বন্দীদের সাথে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। এক বন্দী জানান, রাশিয়ান সেনারা তাঁকে “আমেরিকান মাকড়সা” মনে করত।

২০২৩ সালে হাবার্ড কে মস্কোর কাছে পাকিনোর একটি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি শিশকো এবং আরও ১৩ জনের সাথে ছিলেন। সেখানে বন্দীদের নির্যাতন করা হতো, এমনকি বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। স্ক্যাবিস হওয়ার পর তাঁদের নগ্ন করে ঠান্ডা বেসমেন্টে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। খাবার বলতে ছিল শুধু সেদ্ধ জল আর বাঁধাকপি।

শিশকো বলেন, “স্টিভেন কখনও হাল ছাড়েননি। তিনি আমাদের বলতেন, ‘এরা মানুষ নয়। আশা হারিয়ো না।’ তিনি তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং আমাদের টিকে থাকতে উৎসাহিত করেছিলেন।”

একসময় হাবার্ড বলেছিলেন যে তাঁর বোন হয়তো তাঁকে খুঁজছেন।

অবশেষে মে ২০২৪ সালে হাবার্ড কে মস্কোর আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে তিনি ভাড়াটে সৈনিক হওয়ার অভিযোগ স্বীকার করেন। অক্টোবরে তাঁকে ছয় বছর দশ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

তাঁর বোন প্যাট্রিসিয়া আশা করেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার সাথে আলোচনা করে তাঁর ভাইকে মুক্ত করতে পারবেন। তিনি জানান, তাঁর ভাইকে চপ্পল দিয়ে মারার দৃশ্য দেখে তাঁর ছোটবেলার নির্যাতনের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি কলোরাডোর বাড়ি বিক্রি করে ওকলাহোমায় বাড়ি কেনার পরিকল্পনা করছেন, যাতে তাঁর ভাই মুক্তি পেলে সেখানে থাকতে পারে। তিনি বলেন, “আমি আমার বাড়ি ভালোবাসি, কিন্তু আমার ভাই সবকিছু হারিয়েছে। তাই আমি এটা করছি। আমি তাঁকে একটা ঘর দেব।”

এই মানবিক বিপর্যয়ের শেষ কোথায়, কেউ জানে না। একজন নিঃসঙ্গ আমেরিকান শিক্ষকের জীবন আজ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

সোর্স: দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights