কারও খোঁজ মেলে কারও মেলে না
হাসানুর রশীদ, কক্সবাজার
কক্সবাজারের রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের নন্দাখালী এলাকার কিশোর সৈয়দ করিম ও রিয়ান। পার্শ্ববর্তী মুড়াপাড়া এলাকার তারেক নামে এক যুবক তাদের মালয়েশিয়া যাওয়ার ফাঁদে ফেলে। ২১ জানুয়ারি ওই দুই কিশোরকে কৌশলে নিয়ে যায় তারেক। পরে ৩০ হাজার টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে। নিম্নবিত্ত এই দুটি পরিবার টাকা দিতে না পারায় তারেক তাদের অন্য দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। ওই দুই কিশোরের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অপহরণ, মুক্তপণ আদায়, মালয়েশিয়া পাচার করছে সংঘবদ্ধ চক্র। স্থানীয়দের পাশাপাশি তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শিশু, নারী ও পুরুষ সংগ্রহ করে। প্রলোভন দেখিয়ে সুযোগ বুঝে ট্রলারে তুলে দেয়। এর মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
নিখোঁজ সেয়দ করিমের ভাই রেজাউল করিম জানান, মুক্তিপণ দিতে না পারায় অন্য দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। যে মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছিল এখন সে মোবাইলে কল দিলে বলা হয় করিমকে তারা বিক্রি করে দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে যা গেছে, গ্রামের সহজসরল পরিবারের কিশোর-যুবকদের টার্গেট করে দালালরা। পরে স্বল্পমূল্যে টেকনাফের দুর্গম পাহাড়ে দালাল চক্রের হাতে তুলে দেয়। এরপর আরও বেশি পরিমাণে মুক্তিপণ চেয়ে মোবাইলে বার্তা পাঠায়। যত হাত বদল হয়, মুক্তিপণের টাকা তত বাড়ে। মারধর করেও মুক্তিপণ আদায়ে ব্যর্থ হলে মালেয়শিয়াগামী ট্রলারে তুলে দেয়।
সবশেষ মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে প্রস্তুতিকালে ২৫ জানুয়ারি টেকনাফে পাহাড়ের আস্তানা থেকে ১৭ জনকে উদ্ধার করেছে নৌবাহিনী। তাদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি ও ১৪ জন রোহিঙ্গা। এ সময় আবদুল্লাহ (২৫) নামে এক মানব পাচারকারীকে আটক করা হয়। জানা যায়, সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে ৪০-৫০ জনকে মধ্যম কচ্ছপিয়া পাহাড়ে আটকে রাখার তথ্য পেয়ে টেকনাফ নৌবাহিনীর একটি দল চক্রের মূল হোতা কেফায়াত উল্লাহকে আটকের চেষ্টা করলে সে পালিয়ে যায়। তাকে ধরতে গিয়ে পাহাড়ের ঢালে ভিকটিমদের পাওয়া যায়। টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, এক পাচারকারীকে থানায় হস্তান্তর করেছেন নৌ বাহিনীর সদস্যরা। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মুহম্মদ রহমত উল্লাহ জানিয়েছেন, মানব পাচারকারিরা মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বন্দিশালায় আটকে রাখে। বিশেষ অভিযান চলছে। টেকনাফের বাহারছড়া এলাকা থেকে দুই বাংলাদেশি নাগরিকসহ ১৯ জনকে উদ্ধার করেছেন পুলিশ ও নৌ বাহিনীর সদস্যরা। ২১ জানুয়ারি মধ্যরাতে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মধ্যম কচ্ছপিয়া এলাকা থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা বলে পুলিশ জানিয়েছে। ২৪ জানুয়ারি টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মধ্যম কচ্ছপিয়া এলাকার পাহাড়ের চূড়া থেকে পাঁচ বাংলাদেশি নাগরিক এবং ১০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ২ সহোদর দালাল হারুন (২৫) ও নুর মোহাম্মদ (১৯)। এই আস্তানায় আটকে রাখা আরও ২৩-২৫ জন পালিয়ে আসে। এর মধ্যে রহমত উল্লাহ নামে রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ির এক ব্যক্তি মারা যান। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পালিয়ে যাওয়া অনেকে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড বা অন্যান্য উপকূলীয় এলাকায় আটকও হচ্ছেন।
বাংলাদেশ থেকে বের হওয়ার এক মাসেরও বেশি সময় পর থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্যটনদ্বীপ থালাং জেলায় ২১ জানুয়ারি ৪২ রোহিঙ্গা অভিবাসীকে উদ্ধার ও আটক করেছে সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী। এর মধ্যে ১৯ জন পুরুষ এবং ২৩ জন নারী ছিলেন। যার মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সি ১২ শিশুও রয়েছে। আটকরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তারা ৭৫ জনের একটি দলের সঙ্গে গত ১৬ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে বাংলাদেশ থেকে রওনা করে। পথিমধ্যে বিবাদ শুরু হয় এবং তাদের জাহাজ থেকে একটি চরে নামিয়ে দেয়।
তাদের বহনকারী নৌযানটি পণ্যবাহী জাহাজ ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। পরে তারা আবার ছোট নৌকায় ওঠেন। এদের কেউ অসুস্থ এবং আবার কেউ গর্ভবতী ছিলেন। রোহিঙ্গাদের এই দলটি স্থানীয় পুলিশকে জানিয়েছে, যাত্রার সময় তাদের মারধর করা হয় এবং কেউ কেউ মারা যায়। এরা সবাই মিয়ানমার থেকে আগত উখিয়া টেকনাফের অবস্থানকারী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা বলে জানা গেছে। ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার সেলাঙ্গর রাজ্যের পেতালিং জেলার একটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে পাচারের শিকার হয়ে আসা তিন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে দেশটির পুলিশ। উদ্ধার তিনজনের বয়স ২৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। তবে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি কর্তৃপক্ষ।