‘গত দেড় দশকে অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার উন্নতি হয়নি’
অনলাইন ডেস্ক
গত দেড় দশকে অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার খুব বেশি উন্নতি হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। নতুন জাতীয় ও বৈশ্বিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার ধারণা পুনর্বিবেচনার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
গত ২১-২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ৮ম সানেম বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলন (এসএইসি) ২০২৫-এ ড. রায়হান এই মন্তব্য করেন। তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ধাক্কার জন্য অপর্যাপ্ত সংস্কার, দুর্বল প্রতিষ্ঠান এবং তথ্য ম্যানিপুলেশনের মতো কারণগুলোকে দায়ী করেন।
‘অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার : ভঙ্গুরতাকে স্থিতিস্থাপকতার দিকে নিয়ে যাওয়া’ শীর্ষক এ বছরের সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়া এবং তার বাইরের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, গবেষক, নীতিনির্ধারক এবং উন্নয়ন পেশাদারদের একত্রিত করা হয়েছে।
তিন দিনের এই অনুষ্ঠানে একাধিক প্যানেল আলোচনা, একটি মূল অধিবেশন এবং ২০টি ব্রেকআউট অধিবেশন অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার মধ্যে রয়েছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, দারিদ্র্য ও বৈষম্য, শ্রমবাজারের সমস্যা, শাসনব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানব মূলধন উন্নয়ন এবং জ্বালানি নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান এটি সঞ্চালনা করেন। তিনি বলেন, শ্বেতপত্র কমিটি অনিয়ম মোকাবেলা, মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা এবং সংস্কার প্রস্তাবের উপর জোর দিয়েছে। তবে টাস্ক ফোর্স কমিটি সামষ্টিক এবং ক্ষুদ্র উভয় সংস্কার বিষয়ের ওপর গভীর বিশ্লেষণ করে শ্বেতপত্র তৈরি করেছে। এ কারণে তিনি উভয় সংস্থার প্রতিবেদনকে একে অপরের পরিপূরক বলে মন্তব্য করেন।
এই সম্মেলনটি হাইব্রিড ফরমেটে পরিচালিত হয়েছিল, যে কারণে বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা এতে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন। এই অধিবেশনে বক্তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ; বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন; সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শারমিন্দ নীলোরমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক।
ড. কে. এ. এস. মুরশিদ তার বক্তৃতায় বলেন, রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকরা বিরোধিতা করলেও অর্থনীতিবিদরা বিশ্বাস করেন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় সংস্কার প্রয়োজন, যা ৫০ বছর ধরে অমীমাংসিত পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক স্থান প্রদান করবে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, আর্থিক খাত সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য কৃষিখাতকে শক্তিশালী করতে হবে। কৃষিতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে স্বল্পমূল্যে প্রযুক্তি কৃষকের হাতে কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটাই এখন বড় বিষয়। নতুন জাত উদ্ভাবনে নজর দিতে হবে।
ড. জাহিদ হোসেন সরকারের আর্থিক ও বিদ্যুৎ খাত সংস্কার নীতিগুলোর ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ে গেছি। এখানকার বিনিয়োগ থমকে আছে। রপ্তানিরও একই অবস্থা। মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। বৈদেশিক আয়ের চেয়ে ঋণ বাড়ছে বেশি। একইভাবে রাজস্ব আয়ের তুলনায় স্থানীয় ঋণ বড় হচ্ছে। আর টাস্কফোর্সের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক কোনো সদিচ্ছা তৈরি হবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। বিগত সময়ে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও তার সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়েনি। কিছু ক্ষেত্রে বরং কমেছে। আমাদের পরিসংখ্যানের মান নিয়েও প্রশ্ন ছিল।
অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বড় বড় প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হচ্ছে। এখন আসল পরিশোধের সময় এসেছে। ২০২৬ সাল থেকেই রূপপুর প্রকল্পে আসল পরিশোধ করতে হবে। এটা প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের আগে বৈদেশিক খাতগুলো উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিল। এখন পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর না করে প্রত্যক্ষ করে মনোযোগ দিতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেকে বলছেন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিছিয়ে দিতে। এটা বাস্তবসম্মত হতে পারে না। নেপাল ও ভুটান গ্র্যাজুয়েশন করেছে। আমরা আফগানিস্তানের সঙ্গে বসে থাকতে পারি না। ভর্তুকি থেকে এখন উৎপাদন সক্ষমতার দিকে যেতে হবে আমাদের।
অধ্যাপক শারমিন্দ নীলোরমি শিক্ষা ও পরিবেশগত নীতিতে অপর্যাপ্ততা তুলে ধরেন এবং জনসাধারণের মধ্যে নৈতিক জবাবদিহিতার অভাবের বিষয়ে আলোকপাত করেন।
অধ্যাপক ড. রুমানা হক স্বাস্থ্য খাতের চলমান স্থবিরতার বিষয়ে আলোকপাত করে বলেন, বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার উন্নতি হলে অর্থের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি, খাতটির সার্বিক মানও বৃদ্ধি পাবে। তিনি অকার্যকর যন্ত্রপাতি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অবহেলা, অ-নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাত এবং সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপের অভাবের মতো সমস্যাগুলোর উপর আলোকপাত করেন।
সূত্র : ডেইলি সান।