গ্রাম-শহরে হুন্ডির ছড়াছড়ি

হুন্ডি ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ কাজ করছে না। গ্রামে-শহরে সবখানেই হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন বাড়ছে। রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ নেওয়ার মধ্যেও হুন্ডি বাড়ছে দেশের গ্রাম-শহর সবখানেই। ডলারের দাম বাড়ায় প্রবাসীরা হুন্ডির ওপরই ভরসা করছে। এমনকি ব্যাংকিং খাতে ডলার সংকট থাকায় ব্যবসায়ীরাও হুন্ডিতে লেনদেন করছেন। প্রবাসী, বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত অনাবাসি বাংলাদেশিরা (এনআরবি), ফ্রিল্যান্সার ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশে টাকা নিয়ে আসছেন। আমদানির ক্ষেত্রেও হুন্ডিতে লেনদেন বেড়েছে। ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ানো যাচ্ছে না।

জানা গেছে, অবৈধ মাধ্যম হুন্ডি খেয়ে ফেলছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বিদেশগামী শ্রমিক বাড়লেও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে তুলনামূলক কম। হুন্ডিতে রেমিট্যান্স বেশি আসায় ওইসব ডলার চলে গেছে কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে। এতে কার্ব মার্কেটে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। একই সঙ্গে চাহিদা ও দাম বাড়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের দাম এখন ১২০ টাকা। যদিও ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিপরীতে প্রবাসীরা প্রণোদনাসহ সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ২৪ পয়সা পাচ্ছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে ডলার বাজারে বড় সংকটে পড়ে। ডলার সংকটে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ডলার পাওয়া যাচ্ছিল না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, বাইরে থেকেও ডলার সংগ্রহের জন্য ব্যাংক মরিয়া হয়ে দর বাড়াতে থাকে। এতে ১২০ টাকায় পৌঁছে যায় ডলারের দর। এই সময় বড় ধরনের জটিলতায় পড়ে প্রবাসী আয় সংগ্রহের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে শহর-গ্রামে সবখানে হুন্ডি ছড়িয়ে পড়ে। সরকার রেমিট্যান্স আয়ের ওপর ২ শতাংশ প্রণোদনা দেয়। তবে বর্তমানে বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রণোদনাসহ যে পরিমাণ টাকা দেয় হুন্ডিতে পাঠালে তার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত দুই বছর ধরে ক্রমাগতভাবে কমছে। বর্তমানে দেশের ব্যবহারযোগ্য বা নেট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ বিলিয়ন ডলারে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ২৬ বিলিয়ন ডলারের কথা। দুই বছর আগে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪৮.০৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এরপর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের ধারাবাহিক পতনে এখন অর্ধেকের নিচে নেমেছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্সের বিপরীতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসের ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে ব্যাংক হিসাব পরিচালনায়ও অর্থ খরচ হচ্ছে। এতে বাংলাদেশে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ এখনো সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যে কারণে রেমিট্যান্সের একটি অংশ সার্ভিস চার্জ হিসেবে চলে যাচ্ছে। এতে প্রবাসীদের লোকসান হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অবৈধ হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে প্রবাসীদের একটি বড় অংশ। যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমছে। হুন্ডিতে ডলারের দাম বেশি পাওয়ার কারণে এর জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যাদের মাসিক আয় কম এবং যারা অবৈধ অভিবাসী তারা হুন্ডিতেই টাকা পাঠাতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারের দর বাজারভিত্তিক না করার কারণে রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ অবৈধ হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলো যে দর দিচ্ছে, হুন্ডিওয়ালারা তার চেয়ে বেশি দামে টাকা বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। যে কারণে ব্যাংকিংয়ের চেয়ে হুন্ডি চ্যানেল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক রপ্তানি বেড়েছে। অথচ রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights