চেষ্টা করেও চালু করা যায়নি স্কুলবাস

শামীম আহমেদ

দেশের সবচেয়ে প্রশস্ত ও দৃষ্টিনন্দন সড়ক পূর্বাচলের শেখ হাসিনা সরণি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০০ ফুট চওড়া ১৪ লেনের এক্সপ্রেসওয়েটিতে কখনোই যানজট লাগার কথা না। তবে ব্যতিক্রম ঘটেছে সড়কটির পাশে অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনের অংশে। নিজস্ব পার্কিং না থাকায় সড়কের একটি সার্ভিস রোডকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়া করা গাড়ি রাখার স্থানে পরিণত করা হয়েছে। ফলে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শত শত ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে থাকছে পুরো সড়ক। তৈরি হচ্ছে তীব্র যানজট। ১২ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে ৭-৮ মিনিটে পাড়ি দেওয়ার কথা থাকলেও স্কুলের সামনে আধা কিলোমিটার সার্ভিস রোড পার হতেই লেগে যাচ্ছে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা। সরেজমিনে দেখা গেছে, কুড়িল থেকে কাঞ্চন যাওয়ার পথে প্রথম ইন্টারসেকশনের আগেই অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। ইন্টারসেকশন দিয়ে বিপরীতমুখী সড়কে যেতে ব্যবহার করতে হয় সার্ভিস রোড। আর এই সার্ভিস রোডটিতেই স্কুল চলাকালীন সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ির পার্কিংয়ের কারণে তৈরি হয় যানজট। শুধু অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলই নয়, শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়া করা ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে রাজধানীর সর্বত্র বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আট শতাধিক স্কুলের সামনেই কম-বেশি যানজট তৈরি হচ্ছে। এই যানজটের প্রভাব পড়ছে পুরো শহরের সড়ক ব্যবস্থার ওপরে। ব্যয়বহুল ‘অভিজাত’ স্কুলগুলোর সামনে তৈরি হচ্ছে বেশি যানজট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর যানজটের জন্য এক-পঞ্চমাংশ দায় স্কুলগামী যানবাহনের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি শিক্ষার্থীকে আনা-নেওয়ার জন্য একটি ব্যক্তিগত গাড়িকে চারবার সড়কে নামতে হচ্ছে। একবার স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে। ছুটির পর আবার নিতে আসছে এবং ফিরে যাচ্ছে। আর যারা ফিরে যাচ্ছে না, তারা মূল সড়কে পার্কিং করে রাখছে। ফলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লেন। অথচ একটি স্কুলবাসে অন্তত ৫০ শিক্ষার্থী চলাচল করতে পারে। একই পরিমাণ শিক্ষার্থীর জন্য ৫০টি প্রাইভেট কারের ১০০ থেকে ২০০টি ট্রিপ প্রয়োজন। অর্থাৎ ৫০টি প্রাইভেট কারের বিকল্প হতে পারে একটি স্কুলবাস। তবে স্কুলে জোনিং পদ্ধতি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় গত এক যুগে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সংস্থা স্কুলবাস চালু করার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, গবেষণার তথ্যানুযায়ী ঢাকায় প্রতিদিন যানবাহনের প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি ট্রিপ হয়। এর মধ্যে প্রায় ১৭ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ট্রিপ। কোচিং সেন্টারে যাতায়াত হিসাব করলে সেটা ২০ ভাগ হয়ে যাবে। বাস সার্ভিস চালু করলে এটা অনেক কমে যাবে। তবে এখানে বাস সার্ভিস চালু করলেও খুব একটা সুফল আসবে না। কারণ, এখানে স্কুলগুলোর মানের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। ফলে সেরা স্কুলে পড়ানোর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মতিঝিলে বসবাসকারী একজন অভিভাবক উত্তরায় বাচ্চাকে ভর্তি করাচ্ছেন। ফলে এই ট্রিপগুলো মূল সড়কে চলে আসছে, যা পৃথিবীর কোথাও নেই। আবার বাসগুলো যখন বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থী ওঠা-নামা করবে, তখন শুরুতে যে শিক্ষার্থী বাসে চড়বে তাকে দুই-আড়াই ঘণ্টা বাসে থাকতে হবে। দীর্ঘ সময়ের কথা চিন্তা করে অভিভাবক তাকে বাসে দিতে চাইবে না। তাই জোনিং পদ্ধতি চালু করে যে শিশু যে এলাকার বাসিন্দা, তাকে সেখানকার স্কুলে ভর্তিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলে সে হেঁটে, রিকশায় বা স্কুলবাসে চলে আসতে পারবে। ওই ট্রিপগুলোও মূল সড়কে আসবে না। এ জন্য অবশ্যই সব স্কুলের শিক্ষার মান কাছাকাছি নিতে হবে। এই দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। ঢাকায় কেন ৮-১০টি স্কুল সেরা হবে?

স্কুলবাস চালুর নানা উদ্যোগ : রাজধানীর যানজট নিরসন ও স্কুল শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য ২০০৯ সালে আন্তমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় বোর্ড (ডিটিসিবি) স্কুলবাস সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। সে সিদ্ধান্তের আলোকে ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রাথমিকভাবে ১৪টি বিআরটিসি বাস নিয়ে এ সার্ভিস চালু হয়। পরে ১০০টি বাস চালুর কথা থাকলেও ধীরে ধীরে কমতে কমতে ২০২০ সালে সার্ভিসটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বিআরটিসি সূত্র জানায়, ২০১১ সালে চালু হওয়া ১৪ বাস কিনতে ঋণ নিতে হয় ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৪ টাকা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে টিকিট বিক্রির টাকায় বাস পরিচালনার খরচ ওঠেনি। প্রতিদিন বিআরটিসির খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার ১৬৮ টাকা। গড়ে আয় হয়েছে ১২ হাজার টাকা। এ কারণেই বন্ধ হয়ে গেছে সার্ভিসটি। এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্কুলবাস আমদানিতে কর ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দেন। সে ঘোষণাও কাজে আসেনি। কোনো স্কুল বা সংস্থা স্কুলবাস আমদানিতে আগ্রহ দেখায়নি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম উত্তর সিটির ব্যবস্থাপনায় গুলশানের কয়েকটি স্কুলের জন্য বাস সার্ভিস চালুর ঘোষণা দেন। গত বছরের মে মাস থেকে সার্ভিসটি চালুর কথা ছিল। একই সঙ্গে স্কুলের ৫০০ মিটারের মধ্যে অস্থায়ী দোকানপাট উচ্ছেদ এবং আশপাশে পার্কিং বন্ধের ঘোষণা দেন মেয়র। তবে বছর ঘুরলেও সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।
এ ব্যাপারে জানতে মেয়র আতিকুল ইসলামকে ফোনে না পেয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, উদ্যোগটি এখনো আছে। বাস কেনার অনুমতি পাওয়া যায়নি। চেষ্টা চলছে। কবে নাগাদ চালু করা যাবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এদিকে স্কুলের সামনে যানজট সৃষ্টির জন্য স্কুলগুলোর অনুমোদন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বলেন, স্কুল হতে হবে মূল সড়ক থেকে দূরে পরিকল্পনামাফিক নিরিবিলি এলাকায়। এখানে মূল সড়কের পাশে, বাণিজ্যিক এলাকায়, অলিগলিতে স্কুলের অনুমোদন দিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে স্কুলের সময়ে ওই সড়কে যানজট লাগবেই। এই বিষফোঁড়া দূর করা সহজ হবে না। তবে সব স্কুলের মান উন্নত করতে পারলে ও জোনিং পদ্ধতির মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি নিশ্চিত করতে পারলে এই দুর্ভোগ কিছুটা কমবে। তখন স্কুলবাস চালুও ফলপ্রসূ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights