জাহাজে সাত খুন; ফরিদপুরে দুই পরিবারে শোকের মাতম
কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর
চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার ইশানবালা খালে নোঙর করা এমভি আল-বাখেরা নামের সারবাহী জাহাজে সাতজন নিহতের মধ্যে ফরিদপুরের গোলাম কিবরিয়া (৬৫) ও সবুজ শেখের (২৬) বাড়িতে শোকের মাতম যেন কাটছেই না। একই পরিবারের দুইজনকে হারিয়ে স্বজনদের শান্তনা দেবার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না প্রতিবেশীরা। কিছুক্ষণ পর পর সবুজ, সবুজ বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন তার মা রাজিয়া বেগম।
এদিকে, গতকাল রাতে গোলাম কিবরিয়া ও ভাগ্নে সবুজ শেখের লাশ বাড়িতে এসে পৌঁছালে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। লাশ দুটি এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর পর পরই কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনসহ প্রতিবেশীরা। মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে চাঁদপুর থেকে দুইজনের লাশ এ্যাম্বুলেন্সে করে ফরিদপুরে এসে পৌঁছে রাত ৮টার দিকে।
জানা গেছে, নিহত গোলাম কিবরিয়া (৬৫) চল্লিশ বছর ধরে জাহাজের কাজে যোগ দেন। তিনি এমভি আল-বাকের জাহাজটির মাস্টার ছিলেন এবং তার ভাগ্নে সবুজ শেখ (২৬) একই জাহাজের লস্কর হিসেবে কমর্রত ছিলেন। তারা ফরিদপুর সদরের গেরদা ইউনিয়নের জোয়ারের মোড় এলাকার বাসিন্দা। গোলাম কিবরিয়া সদরের জোয়ারের মোড়ের মৃত আনিসুর রহমানের ছেলে। নিহত অপরজন সবুজ শেখ গোলাম কিবরিয়ার ভাগ্নে। গোলাম কিবরিয়া এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা এবং সবুজ ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে চতুর্থ এবং অবিবাহিত ছিল।
নিহতদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত এক মাস আগে গোলাম কিবরিয়া ও সবুজ শেখ বাড়ি থেকে কাজের সন্ধানে বের হন। সোমবার বিকেলে পরিবারের সদস্যরা এ মৃত্যুর ঘটনা জানতে পারেন। গোলাম কিবরিয়ার জাহাজে এ মাসেই শেষ কর্মদিবস ছিল বলে জানান স্বজনেরা।
নিহত সবুজ শেখের বড় ভাই মিজানুর রহমান ফারুক জানান, এক মাস আগে মামা গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে জাহাজের কাজে যোগ দিয়েছিলেন আমার ভাই সবুজ। তিনি দাবি করেন, হত্যাকান্ডটি পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। তিনি বলেন, আমি লাশ দেখতে গিয়ে অনেকের কাছে শুনতে পেয়েছি নানা কথা। তার মধ্যে জানতে পেরেছি, চট্রগ্রাম থেকে সার নিয়ে জাহাজ ছাড়ার আগে গোলাম কিবরিয়ার সাথে স্থানীয় কয়েক জনের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। এছাড়া গোলাম কিবরিয়া যেহেতু এ মাসেই জাহাজের চাকরি থেকে চলে আসতো, তাই তার কাছে বেশ কিছু টাকা ছিল। এ বিষয়গুলো পুলিশকে খতিয়ে দেখতে হবে।
নিহত গোলাম কিবরিয়ার স্ত্রী রোজি বেগম জানান, তার স্বামীর সাথে সোমবার শেষ কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, জাহাজ ছাড়ার পর আমার সাথে কথা বলবেন। কিন্তু তারপর আর কথা হয়নি। আগামী ১০ জানুয়ারি বড় মেয়ের বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে। সে মেয়ের বিয়ে দেখে যেতে পারলোনা। তিনি বলেন, আমার স্বামী একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। সে না থাকায় আমি আমার ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখন কিভাবে বাঁচবো, আমাদের এখন কি হবে। এ নৃসংশভাবে খুনের সাথে যারা জড়িত তাদের কঠিন শাস্তি চাই আমি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবুজ শেখের মা রাজিয়া বেগম বলেন, আমার ছোট্ট ছেলেটির কি দোষ ছিল। ওর তো কারো সাথে কোন ঝামেলা ছিল না। কেন তারা আমার কোল খালি করলো, যারা আমার কোল খালি করেছে তাদেরও যেন আল্লাহ কোল খালি করে দেয়।
স্থানীয় এলাকাবাসীদের কয়েকজন জানান, নিহত গোলাম কিবরিয়া ও সবুজ শেখের পরিবারটি এখন পথে বসে যাবার যোগার হয়েছে। এ দুটি পরিবারকে সরকার যাতে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয় এটাই তাদের দাবি। আর এ নৃসংশ ঘটনার সাথে জড়িতদের ফাঁসি চান তারা।
নিহত জাহাজ মাষ্টার গোলাম কিবরিয়া ও তার ভাগ্নে সবুজকে বাড়ির পাশে গেরদা ইউনিয়নের স্থানীয় গফুর মাতুব্বরের গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
জানা যায়, জাহাজটিতে থাকা ৮ জনের মধ্যে ৭ জনের লাশ সনাক্ত করেছে পুলিশ। তবে এদের মধ্যে বেঁচে যাওয়া জুয়েল রানার (৩৫) বাড়িও ফরিদপুর সদর উপজেলার বকারটিয়া গ্রামে। জুয়েল চার বছর ধরে ওই জাহাজে কাজ করছিলেন। তিনি বকারটিলা গ্রামের সেকেন্দার খালাসির ছেলে। আহত জুয়েল রানাকে সোমবার দিবাগত রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে নাক, কান ও গলা বিভাগে তাকে ভর্তি করা হয়েছে। জুয়েল রানার শ্বাসনালী কেটে যাওয়ায় সেখানে টিউব যুক্ত করা হলেও তিনি এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। তিনি কোনো কথা বলতে পারছেন না।