তালিকা করেই দায় শেষ
সাখাওয়াত কাওসার
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা হয়। চিঠিও ইস্যু হয়। তবে কোনো ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ছাড়াই চলছে ভবনের ব্যবহার। ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের চিঠি থোরাই কেয়ার করেন ভবন মালিকরা। ফায়ার সার্ভিসের দাবি, তালিকা তৈরির বাইরে কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই সংস্থাটির। অ্যাকশনের বিষয়টি দেখবে রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। তবে ফায়ারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন নগরবিদ এবং ফায়ার এক্সপার্টরা। তারা বলছেন, একটি ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না দেখে কীভাবে ব্যবসা করার লাইসেন্স দিচ্ছে ফায়ার সার্ভিস? কেনই-বা বারবার তালিকা করা হচ্ছে? রহস্যই বা কী? অন্যদিকে রাজউক বলছে, ফায়ারসহ অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে অ্যাকশনে যাবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক (অব.) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মো. শহিদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত আইন আছে কিন্তু প্রয়োগের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ভবন নির্মাণের সঙ্গে অনেক সংস্থা রয়েছে। সবাই নিজস্ব লাইসেন্স বা ছাড়পত্র দিচ্ছে। সবাই কাজ করছে কিন্তু সমন্বয়হীনতার বড় অভাব। কোনো ঘটনা ঘটলে এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দায় চাপায়।
তিনি আরও বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি অথচ আইনের যথাযথ প্রয়োগে খুবই দুর্বলতায় আছি। যারা জননিরাপত্তার স্বার্থে কাজ করেন, তাদের একই ছাদের নিয়ে আসা যায় কি না- প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন বিষয়টা ভাববার সময় এসেছে।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার ৫৮টি মার্কেট ভবন অগ্নিঝুঁকিতে। এর মধ্যে নয়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেগুলোয় মার্কেট ও খাবার দোকানও আছে। এ ছাড়া ১৪টি মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে এগুলো অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। গত বছর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে রাজউকের তালিকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৬৯১টি।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকার একটি ছিল বেইলি রোডের সেই ‘গ্রিন কোজি কটেজ’। ভবনটির সপ্তম এবং অষ্টম তলার মালিক ক্যাপ্টেন (অব.) সরদার মিজানুর রহমান। গত সেপ্টেম্বরে ব্যবসার লাইসেন্স নিতে ফায়ার সার্ভিস অফিসে গিয়েছিলেন তিনি। তখন তাকে ফায়ার সেফটি প্ল্যান জমা দিতে চিঠি দেওয়া হয়। তখন তিনি স্ট্যাম্পে লিখিত উত্তর দিয়েছিলেন পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে তিনি তা জমা দেবেন। এর আগেও ওই ভবনকে দুবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। গতকাল পর্যন্ত তিনি তা জমা দেননি।
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৪৬ তাজা প্রাণের অকাল প্রয়াণের মর্মস্পর্শী ঘটনায় ফের অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। গত দুই দিনে বিভিন্ন ভবন ও মাকের্টে খোঁজ নিয়ে কিছু ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার অনেক এলাকায় বহুতল ভবনের খাবারের দোকানে গ্যাসের চুলা রয়েছে। সেখানে অরক্ষিতভাবে রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার।
এ বিষয়ে পুলিশ বলছে, বেইলি রোডে আগুনের পর রাজধানীর প্রতিটি মার্কেটে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মার্কেটে মার্কেটে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ নজরদারি বাড়িয়েছে। দোকানিরা নিজ উদ্যোগে নষ্ট ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ঠিক করছেন। যাদের নেই তারা নতুন করে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগাচ্ছেন। ফায়ার এসটিংগুইসারগুলো ঠিক রয়েছে কি না সেগুলোও পরীক্ষা করে দেখছেন।
এদিকে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে ফায়ার সার্ভিস তাদের করা তালিকাগুলো আমাদের কাছে জমা দেয় না। গত বছর সিদ্দিক বাজারে একটি মার্কেটে অগ্নিকান্ডের পর আমরা রাজধানীতে ৬৯১টি ভবনের তালিকা তৈরি করেছি। সম্প্রতি আমরা ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট পরিদর্শন করেছি। মৌখিভাবে সতর্কতা দিয়েছি। এ সপ্তাহ থেকেই অভিযান শুরু হবে।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি চেয়ারম্যান স্যারের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে গত তিন মাসে দুটি সমন্বয় মিটিং করা হয়েছে। শিগগিরই কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে অভিযান চালানো হবে। ওই ভবনগুলো যত প্রভাবশালী ব্যক্তিরই হোক না কেন, আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে!
দ্য লাইফ সেভিং ফোর্সের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, আসলে ফায়ারের এখতিয়ার একেবারেই সীমিত। এনফোর্সিং এবং রেগুলেশন ক্যাপাসিটি নেই। আমাদের সিলগালা করার অধিকার দেয়নি সরকার। অনেকেই দেখা যাচ্ছে লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করে যাচ্ছেন। পুলিশ তাদের কিছু বলছেও না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি নেই এমন ভবনের সংখ্যা দেশে হাজার হাজার!!!
বাপার যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবশ্যই ফায়ারের ক্ষমতা আছে। নইলে কী দেখে তারা লাইসেন্স দেয়? এর দায় কিন্তু রাজউক, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদফতর, বিস্ফোরক অধিদফতরও এড়িয়ে যেতে পারে না। গতকাল শনিবার নিউমার্কেটের গাউসুল আজম মার্কেটে আগুনের ঘটনায় ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ায়। এভাবে একের পর এক মার্কেটে আগুনের ঘটনায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ মার্কেট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে আগুনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
যদিও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগুন থেকে রক্ষা পেতে কমিটি করছেন। ফায়ার ফাইটারসহ বাড়াচ্ছেন নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা। খতিয়ে দেখা হচ্ছে আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি। নতুন করে মার্কেটগুলোয় খোঁজ নিতে শুরু করেছে পুলিশ। প্রত্যেকটি মার্কেটে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ফায়ার সূত্র বলছে, অতি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকায় নাম রয়েছে রাজধানীর টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেটের। মার্কেটটিতে সাড়ে ৭০০ দোকান রয়েছে। বেশির ভাগ দোকানই সেমিপাকা। মার্কেটটির ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা বলেন, বেলি রোডের আগুনের কারণে আতঙ্কে রয়েছি। তবে তাদের মার্কেটে যাতে আগুন না লাগে সে জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা। বাকিগুলো হলো- নিউমার্কেট রোডের গাউছিয়া মার্কেট, গুলিস্তানের ফুলবাড়ীয়ার বরিশাল প্লাজা, রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, চকবাজারের আলাউদ্দিন মার্কেট, শাকিল আনোয়ার টাওয়ার, শহিদুল্লাহ মার্কেট, সদরঘাটের শরীফ মার্কেট, মায়া কাটারা (২২ মার্কেট) ও সিদ্দিক বাজারের রোজনীল ভিস্তা।
মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ : জুরাইনের আলম সুপার মার্কেট, খিলগাঁওয়ের উত্তরা মার্কেট, ডেমরার সালেহা শপিং কমপ্লেক্স, মনু মোল্লা শপিং কমপ্লেক্স, দোহারের জয়পাড়ার লন্ডন প্লাজা শপিং মল, ওয়ারীর র্যাংকিন স্ট্রিটের একে ফেমাস টাওয়ার, রোজভ্যালি শপিং মল, নিউ মার্কেটের মেহের প্লাজা, মিরপুর রোডের প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টার, নিউ চিশতিয়া মার্কেট, নেহার ভবন, এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্স, ইসমাইল ম্যানশন সুপার মার্কেট, সুবাস্তু এ্যারোমা শপিং মল।
ঝুঁকিপূর্ণ : ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর জুরাইনের বুড়িগঙ্গা সেতু মার্কেট, খিলগাঁওয়ের তালতলা সিটি করপোরেশন সুপার মার্কেট, খিলগাঁও সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজার মার্কেট, তিলপাপাড়া মিনার মসজিদ মার্কেট, ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজা, ইসলাম প্লাজা, ডেমরার নিউমার্কেট, দোহারের আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স, এ হাকিম কমপ্লেক্স, ঢাকার নবাবগঞ্জের শরীফ কমপ্লেক্স, মিরপুরের বাচ্চু মিয়া কমপ্লেক্স, কাফরুলের ড্রিমওয়্যার, মিরপুর-১ এর এশিয়ান শপিং কমপ্লেক্স, মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট, ফেয়ার প্লাজা, তেজগাঁও শিল্প এলাকার শেপাল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড, নাসা মেইনল্যান্ড, জাকারিয়া ম্যানসন, লালবাগের হাজী আবদুল মালেক ম্যানশন, ওয়ারীর ইপিলিয়ন হোল্ডিং লিমিটেড, মিরপুর রোডের গ্লোব শপিং সেন্টার, মিরপুর রোডের চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট, চাঁদনীচক মার্কেট, নিউ সুপার মার্কেট, নূরজাহান সুপার মার্কেট, হযরত বাবুশাহ হকার্স মার্কেট, নীলক্ষেতের ইসলামিয়া বই মার্কেট, গুলিস্তানের ফুলবাড়ীয়া সুপার মার্কেট-১, ছিদ্দিক বাজারের হান্নান ম্যানশন, সিটি প্লাজা ফুলবাড়ীয়া সুপার মার্কেট-২, গুলিস্তানের নগর প্লাজা, সিদ্দিক বাজারের রোজ মেরিনার্স মার্কেট, ও ছিদ্দিক বাজারের দুকু টাওয়ার।
► বারবার আগুন নিয়ে সংসদে ক্ষোভ