দেশে চাকরি নেই, যুদ্ধের মাঝেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইসরায়েলে ছুটছেন ভারতীয়রা!

অনলাইন ডেস্ক

গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে ইহুদিবাদী দেশ ইসরায়েল। এরই মধ্যে ১১৮তম দিনে পৌঁছেছে এই যুদ্ধ। যুদ্ধে ইসরায়েলের বর্বর আগ্রাসনের জবাবে পাল্টা হামলাও করছে গাজার প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাস।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে নজিরবিহীন হামলা চালায় হামাসের যোদ্ধারা। এর জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল, যা এখনো চলছে। এই হামলার পর ইসরায়েল প্রায় ৮০ হাজার ফিলিস্তিনি শ্রমিককে নিষিদ্ধ করেছে। এ কারণে দেশটিতে শ্রমিকসংকট দেখা দিয়েছে।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ইসরায়েল নির্মাণ খাতকে সম্প্রসারণের জন্য চীন, ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে ৭০ হাজার কর্মী নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। শুধু ভারত থেকেই প্রায় ১০ হাজার কর্মী নিয়োগ দেবে ইহুদিবাদী দেশটি।
এরই মধ্যে ভারতের উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানা ইসরায়েলে চাকরির আবেদন গ্রহণ করছে। হরিয়ানার রোহতক শহরের মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় সারা দেশ থেকে কয়েক হাজার আবেদনকারীর পরীক্ষার আয়োজন করছে। তবে এ বিষয়ে দিল্লিতে ইসরায়েল দূতাবাস কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে।
ব্যবহারিক পরীক্ষা দিতে আসা চাকরিপ্রার্থীদের একজন রঞ্জিত কুমার। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন। পেশায় শিক্ষক। কিন্তু তিনি চিত্রশিল্পী, স্টিল ফিক্সার, শ্রমিক, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ টেকনিশিয়ান ও একজন জরিপকারী হিসেবে কাজ খুঁজে পেতে চান।

৩১ বছর বয়সী রঞ্জিত বলেন, দুটি ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও তিনি দিনে ৭০০ রুপির বেশি আয় করতে পারেন না। ডিজেল মেকানিক হিসেবে কাজ করার জন্য একটি সরকারি ‘বাণিজ্য পরীক্ষায়’ পাস করেছেন। এছাড়া ইসরায়েল আবাসন ও চিকিৎসার সুবিধাসহ প্রতি মাসে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার রুপি দিচ্ছে।

রঞ্জিত আরও বলেন, তার পরিবারের সদস্য সাতজন। তাদের সহযোগিতা করতে হবে। গত বছর তিনি পাসপোর্ট পেয়েছেন। তিনি ইসরায়েলে ইস্পাত ফিক্সার হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী।

তিনি বলেন, “দেশে কোনও নিরাপদ চাকরি নেই। পণ্যের দাম বাড়ছে। ৯ বছর আগে স্নাতক পাস করার পরও আর্থিকভাবে স্থিতিশীল হতে পারিনি আমি।”

রঞ্জিতের মতো সারিতে থাকা চাকরিপ্রার্থীরা ভারতে আনুষ্ঠানিক চুক্তি ও কোনও সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই কাজ করেন। অনেকেরই কলেজ ডিগ্রি আছে, তবু তারা নিরাপদ চাকরির জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। তারা নির্মাণকাজের দিকে ঝুঁকছেন। মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন কাজ করেন। দিনে আয় হয় ৭০০ রুপির মতো।

আয় বাড়ানোর জন্য অনেকে একাধিক কাজ করেন। কেউ কেউ নিজেদের এ পরিস্থিতির জন্য আর্থিক বিপর্যয়, ২০১৬ সালের মুদ্রা নিষেধাজ্ঞা ও করোনার সময়ের লকডাউনকে দায়ী করেছেন। আবার কেউ কেউ সরকারি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ করেছেন। অনেকের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবৈধভাবে যাওয়ার জন্য এজেন্টদের অর্থ প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এই অর্থ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

তারা বলছেন, এ সবই তাদের একটি নিরাপদ, আরও লাভজনক বিদেশি চাকরি খোঁজার জন্য প্ররোচিত করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করার ঝুঁকির বিষয়টি তারা কিছু মনে করছেন না।

রঞ্জিতের মতো আরেকজন চাকরিপ্রার্থী সঞ্জয় ভার্মা। ২০১৪ সালে স্নাতক পাস করেছেন। কারিগরি ডিপ্লোমাও আছে। পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী, রেলওয়েসহ এক ডজনের বেশি সরকারি পরীক্ষায় অংশ নিতে নিতে ছয় বছর পার করেছেন। ২০১৭ সালে ইতালিতে একটি খামারের কাজে প্রতি মাসে ৯০০ ইউরো বেতনের চাকরি হয়েছিল। কিন্তু এ জন্য এজেন্টকে ১ লাখ ৪০ হাজার রুপি দিতে না পারায় তার ইতালিতে যাওয়া হয়নি।

আরেকজন চাকরিপ্রার্থী পারবত সিং চৌহান। তিনি বলেন, মুদ্রা নিষেধাজ্ঞা ও লকডাউনের ধাক্কায় তিনি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যান। ৩৫ বছর বয়সী চৌহান রাজস্থানে অ্যাম্বুলেন্সের চালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজের জন্য মাসে আয় ছিল ৮ হাজার রুপি।

চৌহান বলেন, “অন্য অনেকের মতোই হাইস্কুল শেষে কাজের খোঁজে নেমে পড়ি। স্কুলে পড়ার সময় সংবাদপত্র বিক্রি শুরু করি। এতে মাসে ৩০০ রুপি আয় হতো। মায়ের মৃত্যুর পরপর কাপড়ের দোকানে কাজ নিই। আয় ভালো না হওয়ায় মুঠোফোন মেরামতের কোর্স করি। কিন্তু এতেও খুব একটি সুবিধা হয়নি। তবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ থেকে সাত বছর তাঁর ভাগ্যের উন্নতি হয়েছে। নিজে অ্যাম্বুলেন্স চালাতেন। গ্রামে ছোট ছোট নির্মাণকাজ পরিচালনা করতেন। কিছু ট্যাক্সি কিনে ভাড়া দিতেন।”

তিনি বলেন, “কিন্তু লকডাউন আমাকে শেষ করে দিয়েছে। বন্ধক রাখার সামর্থ্য না থাকায় আমার গাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে। এখন আবারও আমি অ্যাম্বুলেন্স চালাই। সরকারের ছোট ছোট নির্মাণকাজে ফিরে এসেছি।”

হরিয়ানার ৪০ বছর বয়সী টাইলস সেটার রাম। দুই দশক ধরে তিনি এই কাজ করছেন। জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় ও স্থবির মজুরির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তার মেয়ে বিজ্ঞানে স্নাতক করছেন। ছেলে চান চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে। এসব কারণে তিনি দুবাই, ইতালি ও কানাডায় চাকরির জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তবে এজেন্টদের দাবি করা অতিরিক্ত ফি দিতে পারেননি তিনি, তাই যাওয়া হয়নি। বাসাভাড়া, সন্তানদের কোচিং ও খাবারের খরচ—সব মিলিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন রাম।

তিনি বলেন, “আমরা জানি, ইসরায়েলে যুদ্ধ চলছে। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। এখানেও তো মরে যেতে পারি।”

২৮ বছর বয়সী হর্ষ জাত ২০১৮ সালে মানবিক বিভাগে থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। শুরুতে তিনি একটি গাড়ির কারখানায় মেকানিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরে তিনি পুলিশের গাড়িচালক হিসেবে দুই বছর কাটিয়েছেন। এরপর গুরগাঁওয়ে পাব বাউন্সার হিসেবে কাজ করেছিলেন। এতে মাসে আয় হতো ৪০ হাজার রুপি। তিনি বলেন, “এসব কাজে কোনও নিরাপত্তা নেই। দুই বছর পরই চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেয়।”

হর্ষ জাত বলেন, “আমি বিদেশে যেতে চাই। ভালো বেতনের চাকরি পেতে চাই। কারণ, যখন আমার সন্তান হবে, তখন সে আমাকে জিজ্ঞাসা করবে, আমাদের প্রতিবেশীর এসইউভি গাড়ি আছে, আমাদের কেন নেই? যুদ্ধের কারণে আমি ভীত নই।” সূত্র: বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights