নারী পাচারে নতুন মোড়

জিন্নাতুন নূর
বাংলাদেশ থেকে নারী পাচারে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের টার্গেট করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে চীনে পাঠানো হচ্ছে। ভালো চাকরি দেওয়ার আশ্বাস এবং কিছু ক্ষেত্রে চীনা নাগরিকদের সঙ্গে নকল বিয়ের ব্যবস্থা করে এ তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এভাবে চক্রটি বাংলাদেশ থেকে নারীদের পাচারের কাজ করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ থেকে এক দশক আগে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের পাচার শুরু হলেও সম্প্রতি তা উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। গ্রামের যে মেয়েরা দরিদ্র, লেখাপড়া করতে পারছে না, করোনাকালীন পোশাক কারখানা থেকে যাদের চাকরি চলে যায়, যাদের অভিভাবক খুব দরিদ্র তাদের প্রলোভন দেখিয়ে এবং এই অভিভাবকদের একেকজনকে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা দিয়ে রাজি করিয়ে তাদের পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে মেয়ে চীনে গিয়ে ভালো বেতনে চাকরি করবে- এমন আশ্বাস দিচ্ছে। যেসব মেয়েকে বিয়ে করে অবৈধ কাজে বাধ্য করা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তারা এ কাজে রাজি না হলে তাদের কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যারা এরই মধ্যে যৌন পেশায় জড়িয়ে গেছে তারা নিজেদের এলাকার বন্ধু ও পরিচিত মেয়েদেরও চীনে নিয়ে অবৈধ কাজ করানোর চেষ্টা করছে। বিশেষ করে দীঘিনালা এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে অনেক বেশি।

জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে কম বয়সি মেয়েরা এরই মধ্যে পাচারের শিকার হয়েছেন, যাদের অনেককেই চীনে পাচার করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, সম্প্রতি শুধু খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার দুটি ইউনিয়ন থেকেই এ পর্যন্ত ৩৬ জন নারী চীন ও হংকংয়ে পাচার হয়েছে। পুরো উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় পাচারকারীরা ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে পাহাড়ে গেলেও সেখানে তারা কম বয়সি পাহাড়ি মেয়েদের অর্থ ও দামি ফোনের লোভ দেখিয়ে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে গরিব ও নিম্নবিত্ত মেয়েদের সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে জড়ো করে। এ ছাড়া অনেককে উচ্চ বেতনে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখানো হয়। অনেক সময় চীনা নাগরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়া হয়। পরে তাদের চাইনিজ পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে চীনে পাচার করা হয়। কেউ আপত্তি করলে চীনা যুবকের সঙ্গে সাজানো বিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে ভুক্তভোগীকে চীনে পাঠানো হয়। এতে করে কারও সন্দেহ হয় না। আবার একদল ভুক্তভোগীকে ঢাকায় এনে কিছুদিন সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। এরপর তাদের চীনা পাচারকারী চক্রের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়।

চীনের পাচারকারীদের পছন্দ হলে মেয়েদের বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হয়। নিলামে সন্তুষ্ট হলেই জালিয়াতি চক্রের মাধ্যমে জাল পাসপোর্ট ভিসা করে দেওয়া হয়। পাসপোর্ট ভিসা প্রস্তুত হলেই চীনের পাচারকারীদের কাছ থেকে মেয়ে পাচার বাবদ ৬ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে বিভিন্ন ম্যারেজ মিডিয়ার মাধ্যমে বিয়ে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি এক চাকমা নারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানান, তার বোনকে পাচারকারীরা চীনে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আটকে রেখেছে। ভুক্তভোগীকে পাচারকারীরা শিক্ষা ও ভালো ভবিষ্যতের কথা বলে প্রলোভন দেখান এবং তার আপত্তিকর ছবি তুলে বিয়েতে বাধ্য করেন। পুলিশের সিআইডি শাখা সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনাগুলো তদন্ত করছে। জানা গেছে, স্থানীয় পাচারকারীরা দেশে এ ধরনের নকল বিয়ের আয়োজন করে, এরপর ভুক্তভোগী নারীকে পাচার করে দেয়। উত্তরার এক বাসিন্দা জানান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অসহায় নারীদের চীনা নাগরিকদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য এ ধরনের নকল বিয়ের আয়োজন করেন। এ জন্য প্রতি নারীর জন্য এই পাচারকারীরা ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে থাকেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সদস্য নিরুপা দেওয়ান গতকাল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্থানীয় নারীদের পাচারের ঘটনায় আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। বিষয়টি নিয়ে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও কথা বলেছি। পুলিশ বাহিনীও এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখছে। পাচারের শিকার অনেক মেয়ে আমাদেরকে তাদের প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন।

আমাদের কাছে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীর পাচারের খবর এসেছে। এই পাচারের ঘটনা আরও আগে থেকে ঘটলেও সম্প্রতি সময়ে তা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে যারা পাচারের শিকার হয়েছে তাদের অনেকেই পাচারকারী চক্রের সঙ্গে এখন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, সাধারণত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মেয়েদের খুব সহজেই পাচার করা সম্ভব, আবার চীনা নাগরিকদের সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মেয়েদের চেহারায় সাদৃশ্য থাকায় তাদের দেশ থেকে সহজে বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া যায়। আমাদের ট্র্যাডিশনাল লিডারদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছি।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের নতুন উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবিব পলাশ বলেন, খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, প্রধানত খাগড়াছড়ির দীঘিনালা এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। খুব সম্ভবত এই মেয়েদের বিয়ের কথা বলে চীনে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার চীন থেকে ফিরে আসা মেয়েগুলোকে পরিবারও সেভাবে আর গ্রহণ করে না। এ বিষয়ে কারও কাছে যদি কোনো তথ্য থাকে এবং কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের সাহায্য চায় আমরা তাদের সহযোগিতা করব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights