নূরলদীনের বীরত্বগাঁথার গল্প বলে ফুলচৌকি

নজরুল মৃধা, রংপুর

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ময়েনপুর ইউনিয়নের ফুলচৌকি মসজিদের গেটের সামনে শায়িত রয়েছেন ব্রিটিশবিরোধী ও কৃষক আন্দোলনের নেতা নবাব নূরলদীন। যার আসল নাম নূরউদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জং। ফুলচৌকিতে ১৭ শতক জমির উপর ৩ গম্বুজের ২ কাতার বিশিষ্ট একটি মসজিদ এখনো বীরত্বগাঁথা প্রচার করছে। এই মসজিদটি ১২২০ বঙ্গাব্দের ২৫শে ভাদ্রে নির্মিত হয়। মসজিদের সামনে ২৮ শতক জমির উপর একটি কবরস্থানে শায়িত রয়েছেন শহীদ নবাব নূরউদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং। তিনি ছিলেন, দিল্লীর সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের আপন চাচাতো ভাই ও ভগ্নিপতি।

ফুলচৌকি মসজিদের পাশে ধ্বংস প্রায় ইটের দেয়াল দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটিই ছিল নূরলদীনের বসতভিটার শেষ চিহ্ন। সেই বাড়ির সামনে নূরলদীনের বংশের অন্যান্য সদস্যদের পরিচয় সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। সেই সাথে ফুলচৌকি মসজিদের সামনে নূরলদীনের কবরেও একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গানো রয়েছে। সেখানে তার বীরত্বগাঁথার কথা লেখা রয়েছে।

ইতিহাস বলছে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ অপশাসন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচার-নির্যাতন, ইজারাদার হরেরাম সেন এবং দেবীসিংহের জুলুমে কৃষক প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। সেই সময় কৃষক প্রজাদের উপর অন্যায়-অত্যচারের বিরুদ্ধে রংপুর অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন মন্থনার জমিদার জয় দূর্গা দেবী চৌধুরানী, ইটাকুমারীর জমিদার শিবচন্দ্র রায়, সন্যাস বিদ্রোহের নায়ক ভবানী পাঠক, দিরাজী নারায়ণ, মিঠাপুকুর ময়েনপুর ফুলচৌকির নূরলদীন, রাজা দয়াশীল, মুন্সি কাদের উল্লাহ খাঁ ওরফে মুসা শাহ।

১৭৮৩ সালের শুরুতে প্রজা বিদ্রোহী মারাত্মক আকার ধারণ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের ইজারাদার দেবীসিংহের ইংরেজ প্রধান ঘাঁটি লালমনিরহাটের মোঘলহাট আক্রমণ করে বিদ্রোহী প্রজারা। সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধে নবার নূরলদীনের দেওয়ান রাজা দয়াশীল প্রাণ হারান। নূরলদীনের সংগ্রামে দর্জি নারায়ণ, কেনা সরকার, ইসরায়ের খাঁসহ যোদ্ধাদের হাতে দেবীসিংহ পর্যুদস্ত হন। ওই বছর জানুয়ারি মাসেই জমিদারি লাভের আশায় দিবা ও নিশি নামের দুই বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামের মোঘলহাটে ব্রিটিশ সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণে নূরলদীন গুরুতর আহত হন। তাঁকে জন্মস্থান মিঠাপুকুরের ফুলচৌকিতে আনা হলে ওই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারিতে তিনি মারা যান। এরপর তাঁকে ফুলচৌকি মসজিদের সামনে কবরস্থ করা হয়। ইংরেজ শাসন উৎখাতে ১৭৬০ থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত নূরলদীন অসংখ্যবার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ব্রিটিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে।

ফুলচৌকি মসজিদের মোতয়াল্লী সাজেদুল কবির চৌধুরী জানান, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নিজের জীবনের পরোয়া না করেই নূরলদীন শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর বীরত্বের সামনে ইংরেজ ও তাদের দোসররা একাধিকবার পরাজিত হয়েছিল। তাকে কেউ স্মরণ করে না। আমরা চাই নূরলদীনের বীরত্বের ইতিহাস পাঠবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হউক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights